কৃষ্ণ এবং অর্জুন কথা: Krishna and Arjuna, It can change your life

যুদ্ধক্ষেত্রে কৃষ্ণ এবং অর্জুন – Krishna and Arjuna

Krishna and Arjuna : পুরাকালে ভারতবর্ষে বিচিত্রবীর্য নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর তিন পুত্র ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর। ধৃতরাষ্ট্র বড় ছেলে হয়েও জন্মান্ধ ছিলেন বলে রাজ্য পেলেন না, পাণ্ডু রাজা হলেন। ধৃতরাষ্ট্রের দুর্যোধন প্রভৃতি একশাে ছেলে। পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র-ধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব।

Whatsapp গ্রুপে যুক্ত হন
Telegram গ্রুপে যুক্ত হন

রাজকুমারেরা ছােট থাকতেই পাণ্ডু মারা যান বলে ধৃতরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সব ছেলেরাই এক সঙ্গে মানুষ হয়েছিলেন, যুদ্ধবিদ্যাদি শিখেছিলেন। তারা সব ক্রমে বড় হয়ে উঠলেন।

রাজ্য ন্যায় যুধিষ্ঠিরাদির প্রাপ্য বলে দুর্যোধন আগে থেকেই তাদের মেরে ফেলার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। বহু রকমে অন্যায় ভাবে তিনি কষ্ট দিয়েছেন তাঁদের। পরে ধৃতরাষ্ট্র সব দিক ভেবে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধনকে রাজ্য ভাগ করে দিলেন।

দ্রৌপদীর-বস্ত্রহরণ

দুর্যোধনের তাও সহ্য হল না। গােটা রাজ্যটা তার চাই। যুধিষ্ঠিরকে কপট পাশা খেলায় হারিয়ে তিনি পাঁচ ভাইকে দ্রৌপদী সহ বনে পাঠিয়ে দিলেন। প্রকাশ্য রাজসভায় সকলের সামনে এনে দ্রৌপদীর অপমানের একশেষ করলেন। দুর্যোধনের এত সব অত্যাচার নীরবে সহ্য করার পর বনবাস থেকে ফিরে এসে যুধিষ্ঠির নিজের রাজ্য ফিরে চাইলেন। দুর্যোধন ফিরিয়ে দিতে রাজী হলেন না।

শান্তিতে সব মিটমাট করে নেবার জন্য যুধিষ্ঠির শেষে পাঁচ ভাই-এর জন্য মাত্র পাঁচখানি গ্রাম চাইলেন যাতে ক্ষত্রিয়জনােচিত গ্রাসাচ্ছাদন কোনরূপে নির্বাহ করা যায়। দুর্যোধন বিনা যুদ্ধে তাও দিতে রাজী না হওয়ায় অবশেষে দুপক্ষে যুদ্ধ বাধে। কুরুক্ষেত্রের মাঠে এ যুদ্ধ হয়।

সখা, আমি যুদ্ধ করব না…

যুদ্ধ আরম্ভ হবে, দুপক্ষের সেনা ও সেনা-নায়কেরা দুপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। রাজা, সেনাপতি প্রভৃতি সবাই এসে দাঁড়িয়েছেন নিজের নিজের জায়গায়। সবাই তৈরী, একটু পরেই সংগ্রাম বাধবে। এমন সময় যুধিষ্ঠিরের পক্ষের মহাবীর অর্জুন তাঁর সখা ও সারথি শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “সখা, একবার দু-দলের সেনার মাঝখানে আমার রথটা নিয়ে চল; দেখি যুদ্ধ করার জন্য দুপক্ষে কারা সব সমবেত হয়েছেন।”

শ্রীকৃষ্ণ তার কথা মত রথ মাঝখানে এনে দু’দলের সেনানীদের পরিচয় দিতে লাগলেন।

সব দেখে শুনে অর্জুনের হাত-পা অবশ হয়ে এল। শরীর কাঁপতে লাগল, হাত থেকে ধনুক পড়ে গেল। জলভরা চোখে আকুলভাবে শ্রীকৃষ্ণের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, “সখা, আমি যুদ্ধ করব না।”

আরো পড়ুন : [আপনার সন্তানকে আদরে বাঁদর করবেন না | Role of parents in child development]

সে কি কথা? এত কাণ্ডের পর অর্জুন শেষ মুহূর্তে একি বলছেন? বলছেনই বা কেন? শ্রীকৃষ্ণ তাে জানেন, ভয় পাবার লােক অর্জুন নন; মহাবীর, মহাপরাক্রমশালী, মহাসাহসী তিনি। এর আগে বহু যুদ্ধে নিজের অসীম শক্তি ও সাহসের পরিচয় তিনি দিয়েছেন দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের সময়কার যুদ্ধে, গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধে, বিরাটরাজের গােধনহরণের সময়কার যুদ্ধে৷ গােধন হরণের সময় অর্জুন একাই তাে বিপক্ষের সব বীরকে পরাজিত করে বিরাটরাজের গােধন ফিরিয়ে এনেছিলেন। তাছাড়া, গুরু দ্রোণাচার্য, দেবরাজ ইন্দ্র এবং দেবাদিদেব মহাদেব তাঁকে যেসব অস্ত্র দিয়েছেন, সেগুলির সাহায্যে ইচ্ছা করলে তিনি মুহূর্তের মধ্যে শত্রুদের সকলকেই একসঙ্গে ধ্বংস করে দিতে পারেন। কাজেই ভয়ের কথা উঠতেই পারে না।

ব্যাপার কি তবে? মনের জোরও তাে কম নয় তাঁর! অমিতশক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধনের এত অপমান, এত লাঞ্ছনা সব নীরবে সহ্য করে গেছেন শুধু কর্তব্যবােধে, যুধিষ্ঠিরের মুখ চেয়ে।

তুচ্ছ দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বীরের মত মাথা তুলে দাঁড়াও

অর্জুন বললেন, “সখা, এই দ্রোণাচার্য আমার গুরু, দুর্যোধনরা আমার জেঠতুতাে ভাই, পিতামহ ভীষ্মের কোলেপিঠে চড়ে মানুষ হয়েছি ছেলেবেলায়। এঁরাই তাে সব বিপক্ষে। আমাদের ওপর এঁরা যত অন্যায়, যত অত্যাচারই করে থাক, এঁদের হত্যা করে এদের রক্তমাখা অন্ন খেয়ে রাজ্য ভােগ করার চেয়ে বরং ভিক্ষা করে খাব, সেও ভাল।”

“তাছাড়া, তুমি তাে আমার মনের কথা ভাল করেই জান। এ রাজ্য তাে দূরের কথা, এদের হত্যা করে আমি স্বর্গরাজ্যও চাই না। নিজের জন্য কিছুই চাই না আমি, তুমি জান, আমি শ্রেয়ঃ চাই, চিরন্তন আনন্দ চাই। এ যুদ্ধ আমি করব না।”

শুনতে কত বড় কথা বলে মনে হয়। মনে হয়, এর চেয়ে বড় মনুষ্যত্বের কথা, ধর্মের কথা আর কি হতে পারে? শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু অর্জুনকে এর জন্য বাহবা না দিয়ে উল্টে গালাগাল দিলেন—“অর্জুন, তােমার কাজে ক্লীবতা প্রকাশ পাচ্ছে। তােমার ব্যবহার দেখে তােমার মধ্যে আর্যসভ্যতা আছে বলেই মনে হচ্ছে না। তােমার পক্ষে এ যুদ্ধ করাটা ধর্মাচরণ হবে না; সেটা হবে মনের দুর্বলতার কাছে মাথা নােয়াননা। হৃদয়ের এ তুচ্ছ দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বীরের মত মাথা তুলে দাঁড়াও।”

Krishna and Arjuna

অর্জুন বললেন, “দেখ সখা, এই বিশ্রী পরিস্থিতিতে পড়ে আমার বুদ্ধিতে সব তালগােল পাকিয়ে যাচ্ছে। তুমি কি আমায় যুদ্ধে গুরু, ভাই, পিতামহ প্রভৃতিকে হত্যা করতে বলছ? একটা জটিল সমস্যায় পড়ে গেছি। কোনটা করা উচিত, কোনটা অনুচিত, কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি আমায় ভাল করে বুঝিয়ে কর্তব্য কি তা ঠিক মত বলে দাও।”
শ্রীকৃষ্ণ তখন নানাদিক থেকে নানাভাবে অর্জুনকে বুঝিয়ে দিলেন যে, অর্জুন যখন ক্ষত্রিয়-রাজকুমার, হাজার হাজার লােকের রক্ষা ও পালনের দায়িত্ব যখন তাঁর, তখন রাজ্যে অন্যায়ের প্রতিকার তিনি না করলে আর কে করবে? এই কর্তব্য পালনের জন্য প্রয়ােজন হলে শক্ত হয়ে পিতামহ প্রভৃতির সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হবে বৈকি। আর অপরের কল্যাণের জন্য নির্লিপ্ত হয়ে, আত্মস্থ হয়ে, সাধারণ দৃষ্টিতে অতি গহিত কর্ম বলে প্রতীত এসব কাজ করলেও তাতে মানুষের অধর্ম হয় না; ঠিকভাব নিয়ে করতে পারলে এতে মানুষ আত্মজ্ঞান পর্যন্ত লাভ করে ধন্য হয়ে যায়।

এই সময়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে প্রথমেই বেদান্তের অদ্বৈতজ্ঞানের কথা বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, আমরা সাধারণ অবস্থায় মনে করি বটে আমি একে মেরে ফেললাম বা আমি বুঝি এর হাতে নিহত হলাম, কিন্তু তা সত্য নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে যেমন ঝড় বৃষ্টি প্রভৃতি হয়, সেইরকম প্রকৃতির নিয়মেই মানুষের মন, বুদ্ধি প্রভৃতি পরিচালিত হয়ে তাকে দিয়ে সব কাজ করায়। আমাদের ‘আমি’-বােধ এই শরীর মনবুদ্ধির খাঁচায় আবদ্ধ থাকে বলে আমরা মনে করি আমরা বুঝি নিজে এসব করছি। মেঘ যদি মনে করে আমি নিজের ইচ্ছায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, জল দিচ্ছি, সেটা যেমন হাসির কথা হয়, যারা জ্ঞানলাভ করেছেন তাঁদের কাছে আমাদের এই ‘আমি করছি’-ও ঠিক তেমনি হাসির কথা বলে মনে হয়। তা ছাড়া জ্ঞানলাভের আগেও আসল মানুষ মরে না। মৃত্যুকালে সে সূক্ষ্ম-শরীর নিয়ে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। আবার নতুন একটা দেহ নিয়ে জন্মায়—যেমন ছেড়া কাপড় ফেলে দিয়ে নতুন জামাকাপড় পরি আমরা।

এসময় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে (Krishna and Arjuna) বুঝিয়ে দেন যে, বিভিন্ন মানুষের চিন্তাধারা ও রুচি বিভিন্ন বলে এই সত্যে পৌঁছানাের জন্য বিভিন্ন রকম ধর্মপথ সৃষ্ট হয়েছে। এগুলিকে পৃথক বলে মনে হলেও উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সব পথেরই এক। শরীর-মনের খাঁচায় ঘেরা ‘আমি’-টার সীমা ক্রমে বাড়িয়ে দিয়ে, ছােট গণ্ডিগুলাে ক্রমে ভেঙ্গে ফেলে সব পথই শেষকালে মানুষকে বেদান্তোক্ত সর্বব্যাপী চৈতন্যে পৌঁছে দেয়।

1.ভক্তিপথ :

এ পথের একটি হচ্ছে, বিশ্বের এই চরম সত্যকে আমাদেরই মত দেহ মনবিশিষ্ট একজন বলে ভেবে তাকে ভালবাসতে শেখা। তার ইচ্ছাতেই সবকিছু হচ্ছে জেনে তার মুখ চেয়ে সবকিছু করে যাওয়া। ভালবাসার সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশী পরিচিত। সেজন্য এপথে চলা সকলের পক্ষে সহজ। এ পথকে ভক্তিপথ বলে। ভালবাসার সাধনা করতে করতে ভালবাসা যত গভীর হয়, মানুষ ততই নিজেকে ভুলে যায়; শেষে ভালবাসার পাত্রের সঙ্গে নিজেকে সে মিশিয়ে দেয়।

2. জ্ঞানপথ:

আর একটি পথ হচ্ছে বিচার করে, গভীরভাবে চিন্তা করে ঠিক ঠিক ধারণা করার চেষ্টা করা যে, আমি শরীর, মন, বুদ্ধি প্রভৃতি থেকে আলাদা; আমি চিরমুক্ত, জন্মমৃত্যু নেই আমার; আমি সব ঠাঁই জুড়ে আছি। জ্ঞানপথ বলে একে। যে সব মানুষের বিচার-প্রবণ বেশী, ভালবাসা প্রভৃতি কোমল মনােবৃত্তিগুলিকে দুর্বলতা বলে ভাবে যারা, তাদের এ পথে চলা খুব সুবিধা। এভাবে চলতে চলতে একদিন জ্ঞানের দরজা খুলে যায়।

3. রাজযােগের পথ :

আর একটা পথের নাম রাজযােগের পথ। খুব মনের জোর নিয়ে জন্মায় যারা, ইচ্ছা করলেই যারা জোর করে মনকে বাইরের জিনিসের চিন্তা থেকে টেনে এনে চুপ করে বসিয়ে রাখতে পারে, অটুট ব্রহ্মচর্য পালনের শক্তি আছে যাদের, এপথ তাদের পক্ষে প্রশস্ত। ঘন্টার পর ঘন্টা এক জায়গায় চুপ করে বসে দেহ-মন স্থির করার চেষ্টা করতে হয়; মন একটি মাত্র বিষয় স্থির করে, পরে একেবারে চিন্তাশূন্য করার চেষ্টা করতে হয়। শরীর যেন সরা, আর আমাদের মন যেন জল। মনে সব সময় চিন্তার ঢেউ উঠছে বলে তার মধ্যে আমাদের স্বরূপ ঠিক মত ফুটে ওঠে না। সরার জল স্থির হলেই তার মধ্যে যেমন সূর্যকে ঠিক ঠিক প্রতিবিম্বিত দেখা যায়, আমাদের মন চিন্তাশূন্য হলেই তেমনি আমাদের যথার্থ স্বরূপ ফুটে ওঠে সেখানে। চেষ্টা করতে করতে এপথে সত্যলাভ, জ্ঞানলাভ করে মানুষ।

4. নিষ্কাম কর্মের পথ :

আর একটি পথ হচ্ছে নিষ্কাম কর্মের পথ। ফলাকাঙ্গাশূন্য হয়ে সুখ দুঃখ প্রভৃতিতে মন নির্লিপ্ত রেখে শুধু কর্তব্যবােধে কর্ম করার চেষ্টা করতে করতেই মানুষের জ্ঞানলাভ হয়। প্রকৃতির গুণেই সব কাজ হচ্ছে, আমি কিছুই করছি না; অথবা ঈশ্বরের তুষ্টির জন্য সব কিছু করছি— যেমন করাচ্ছেন তিনি, যেমন ইচ্ছা তার; এ দুটি ভাবের যে কোন একটি অবলম্বন করে এপথে এগিয়ে যাওয়া যায়। কোন কিছুতে বিশ্বাসী না হয়েও, শুধু নিজের জন্য কিছু না চেয়ে অপরের কল্যাণের জন্য কাজ করার ভেতর দিয়েও মানুষ এ পথে এগিয়ে যায়। এভাবে কাজ করতে করতে একদিন মানুষের সীমায়িত ‘আমি’-বােধের সীমা ভেঙ্গে যায়, আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় সে।

মােটামুটি এই চারটিই প্রধান পথ।

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আরও অনেক কথা বলে বােঝাবার পর অর্জুন বুঝলেন যে, এ যুদ্ধ তার ধর্মপথে বাধা হবে না, বরং তাকে আত্মজ্ঞানলাভের পথে এগিয়েই দেবে। তখন তিনি যুদ্ধ করতে সানন্দে রাজী হলেন, সিংহবিক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে ধনুক তুলে নিয়ে টঙ্কার দিলেন। শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “সখা, যে মােহ, যে সন্দেহ আমার মন-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করেছিল, তােমার কৃপায় তা এখন কেটে গেছে।”

আমরা অনেক সময় ভাবি ধর্ম ধর্ম করেই বুঝি আমাদের জাতটা উৎচ্ছন্নে গেছে; কর্মবিমুখ শক্তিহীন কাপুরুষের দলে পরিণত হয়েছে। কথাটা যে কতটা অন্তঃসারশূন্য, আখ্যানটি পড়ার পর তা বলে বােঝাতে হবে না। জীবনে ধর্মকে ঠিক মত রূপায়িত করতে না পারলে, স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ধর্মের অপব্যবহার করলে অবশ্যই এসব দোষ আসে। কিন্তু বেদান্তের ঠিক ঠিক চর্চা মেষশাবককে সিংহ-শিশুতে পরিণত করে, মানুষকে দেবতার চেয়েও বড় করে তােলে।