Soul and Peace: আত্মা ও তার অদৃষ্ট, স্বামী অভেদানন্দ

Soul and Peace
Soul and Peace

Soul and Peace : আত্মা ও তার অদৃষ্ট-সম্বন্ধে প্রশ্ন সহজেই সকল মনে জেগে থাকে। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকল মনকে কোন প্রশ্নই এমনভাবে স্পর্শ করে না, কোন সমস্যাই মানব-মনকে এতো ভাবায় না। প্রাচীনকাল থেকে মুনি, ঋষি, দার্শনিক ও চিন্তাশীলরা এই প্রশ্নের সমাধান করবার চেষ্টা ক’রে এসেছেন নানাভাবে। সেই চেষ্টার ফলে ঐ বিষয়ে নানা সিদ্ধান্ত গড়ে উঠেছে। সেগুলির কয়েকটি বেশ কিছু লোকের মনেও ধরেছে। কেউ বলেন, দেহ-নিরপেক্ষ আত্মা ব’লে কোন-কিছু নেই ; কেউ-কেউ আবার আত্মা ব’লে কোন বস্তুকেই স্বীকার করেন না। যাঁরা দেহ-নিরপেক্ষ আত্মায় বিশ্বাসী, তাঁরা এর নিত্যতায় বিশ্বাস করেন। যাঁরা আত্মায় অথবা দেহ-নিরপেক্ষ আত্মায় বিশ্বাস করেন না, তাঁরা ঐ সমাধানে তুষ্ট হন না।

Whatsapp গ্রুপে যুক্ত হন
Telegram গ্রুপে যুক্ত হন

এমন কতিপয় লোক আছে যারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের আত্মা ব’লে কোন জিনিস নেই। কিন্তু মানব-সমাজের সব ধর্মই আত্মার অমরত্বে আস্থা স্থাপন করার নির্দেশ দেয় এবং শিক্ষা দেয় যে, মৃত্যুর পরও আত্মা থাকে, মৃত্যুর পরে ভাল কর্মের জন্য স্বর্গ-সুখ অথবা মন্দ কর্মের জন্য শাস্তিভোগ করে। কিন্তু এইসব ধারণার প্রতিষ্ঠা হ’ল প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থ বা শ্রেষ্ঠ মুনিঋষিদের বা সত্যদ্রষ্টাদের গ্রন্থ ও বাণীর ওপর।

আত্মার অমরত্ব (Soul and Peace)

খ্রীষ্টানদের ভেতর সাধারণ বিশ্বাস যে, আত্মার অমরত্ব বা অমর জীবন যীশুখ্রীষ্টই সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং যীশুখ্রীষ্টের জন্মাবার আগে আত্মার অমরত্ব বিষয়ে বিশ্বাস পৃথিবীতে ছিল না এবং যে-কেউ অমরত্ব বা অমর জীবন লাভ করবে তাকেই যীশুখ্রীষ্টের সাহায্য নিতে হবে, নিজে নিজে পারবে না। কিন্তু যখন আমরা খ্রীষ্টপূর্ব যুগের ধর্ম ও শাস্ত্রগুলি পড়ি তখন দেখি যে, আত্মার অমরত্ব বা অমর জীবন বিষয়ে বিশ্বাস প্রাচীন ইজিপ্ট, চাড়িয়া, ভারত, রোম, গ্রীস, পারস্য প্রভৃতি দেশের লোকের মধ্যে সর্বতোভাবে ছিল। সুতরাং পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মগুলির আলোচনা করলে খ্রীষ্টানধর্মে যে বলা হয়েছে একমাত্র যীশুখ্রীষ্টই শাশ্বত জীবন মানুষকে এনে দিতে পারে এবং যীশুর অনুগ্রহ ছাড়া স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করা যায় না—সেই সমস্ত মিথ্যা প্রমাণ হয়ে যায়।

আত্মা ও পার্থিব জড়শরীর (Soul and Peace)

হতে পারে যে, কয়েকটি ইহুদীজাতি ধর্মশাস্ত্র বিশ্বাস করতো না বা সেসব বিষয় সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল; ভগবান যীশু তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু তাই ব’লে একমাত্র তিনিই সর্বপ্রথমে পৃথিবীতে মানুষের জীবনে শাশ্বত আলোকের সন্ধান দিয়েছিলেন—একথা কে স্বীকার করবে ? যদিও বেশীরভাগ ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে, অমর আত্মার অস্তিত্ব আছে, মৃত্যুর পরেও আত্মার নাশ হয় না, আত্মা অক্ষত অবস্থায় থাকে ; তবুও প্রগতিশীল পণ্ডিতরা ধর্মশাস্ত্রের এসকল মতবাদের প্রামাণ্য বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান করে তাঁরা নাকি সিদ্ধান্ত করেছেন, আত্মা ও পার্থিব জড়শরীর একই জিনিস, কিংবা আত্মা দেহের কোন শক্তি বা উপাদানের পরিণতিবিশেষ, দেহ ছাড়া আত্মার কোন পৃথক অস্তিত্ব নেই। তাঁদের সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে তাঁদের সুদৃঢ় যুক্তিও আছে।

আরো পড়ুন : [কৃষ্ণ এবং অর্জুন কথা | Krishna and Arjuna | It can change your life]

তাঁদের মতে, বৈজ্ঞানিকরাও দেহ ছাড়া আত্মার পৃথক সত্তা আছে কিনা তা জানার জন্য গবেষণা করেছেন এবং এই বিরাট রহস্যের সমাধানের জন্য তাঁরা কোন চেষ্টা করতেই বাকী রাখেননি। যতরকম সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছে সেগুলি তাঁরা কজে লাগিয়েছেন মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক থেকে কোন্ জিনিস বার হয়ে যায় তা দেখার জন্য ।

জীবজন্তুর মাথায় অস্ত্রোপচার করে তাঁরা দেখেছেন। মানুষ যখন মরে যায় তখনও সতর্কভাবে সযত্নে তাঁরা পরীক্ষা ক’রে দেখেছেন কোন জিনিসটি দেহকে ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁদের সকলরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। জীবন-মৃত্যু রহস্যের সমাধান করতে কম চেষ্টা মানুষ করেনি, কিন্তু সমস্ত পরিশ্রমই বিফল হয়েছে, আর সেজন্যই অনেক লোক আত্মার অস্তিত্ব বিষয়ে অবিশ্বাসী, নাস্তিক ও জড়বাদী। সেজন্যই প্রত্যক্ষের বাইরে কোন জিনিসকে বিশ্বাস করতে তাঁরা চাননি, আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে যুক্তি দেখালেও তাঁরা শোনেননি, বরং জড় থেকেই চৈতন্যের উদ্ভব হয়েছে একথা তাঁরা বিশ্বাস করেন। নাস্তিক ও জড়বাদীরা বলেন—চৈতন্য, জ্ঞান ও মন সবকিছুকেই সৃষ্টি করেছে দেহ, দেহ ছাড়া আত্মার পৃথক অস্তিত্ব নেই, দেহ যতদিন থাকবে ততদিন আত্মা থাকবে, দেহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও মৃত্যু হবে, কেননা মৃত্যুর পর চেতন আত্মা আলাদাভাবে যে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়, তা তাঁরা কখনো চোখ দিয়ে দেখেননি। তবে এও ঠিক যে, জড়প্রকৃতি থেকে চৈতন্য বা বুদ্ধি সৃষ্টি হয়েছে একথা আজ পর্যন্ত কেউ প্রমাণ করতে পারেনি।

সত্যকার কথা এই যে, দেহ-ব্যতিরিক্ত অথচ দেহকে নিয়ন্ত্রিত করছে, দেহের সকল কিছুর ওপর কর্তৃত্ব করে তাদের কর্মপ্রেরণা দিচ্ছে, এমন আত্মার অস্তিত্ব যদি আমরা অস্বীকার করি তবে নৈতিক, মনোবৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক কতকগুলি প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হ’তে হয়, কেননা ঐ ধরনের সচেতন আত্মাকে স্বীকার না করার অর্থ হ’ল নৈতিক নিয়ম-নীতিকে অচল করে দেওয়া ও সঙ্গে সঙ্গে আমরা হয়ে দাঁড়াই জড় যন্ত্রবিশেষ ছাড়া অন্য কিছু নয়।

জীবন যদি দীপশিখার মতো নিভে যায় তো সেই জীবনের জন্য এতো সংগ্রাম করা কেন ? কেন এতো দুঃখ-কষ্ট ভোগ করা তার জন্য ? স্থুলদেহ লোপ পাবার সঙ্গে সঙ্গে যদি সত্তাই নষ্ট হয় তো মানুষ ধর্মজীবন যাপন করবে কেন? কেন তবে আমরা প্রত্যেককে হত্যা করি না, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে তাদের কাছ থেকে সবকিছু অপহরণ করি না ? ভবিষ্যৎ যা হয় হবে। প্রত্যেক লোকই তাহলে পুরোদস্তুর স্বার্থপর হয়ে পড়বে এবং নৈতিক মানও তাদের খর্ব হবে।

আত্মা শাশ্বত ও অমর

আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, চরিত্রগঠন প্রভৃতি আর দরকারী বলে অনুভূত হবে না। তাহলে এ-যাবৎ মানবসমাজ যেসব কৃষ্টি ও শিল্পনীতির মূল্যবোধ নিরূপণ করেছে তা নষ্ট হয়ে যাবে। স্ত্রী-পুত্রের প্রতি যে সাধারণ স্বার্থগন্ধহীন মমতা ও ভালবাসা তাও প্রতারিত ও লাঞ্ছিত হবে আর তাহলে এই বিশ্ব-সংসারে শুধু কি আমরা উদ্দেশ্য ও দায়িত্ববিহীন খেলাই খেলে যাবো ? না, তা কখনো হয় না; কেননা তাই যদি হয় তবে সাংসারিক জঞ্জালরূপ দুঃখ-কষ্টকে এড়াবার জন্য আমাদের আত্মহত্যা করতে হয়, ধর্মশাস্ত্রগুলিকে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিয়ে, দেবদেবীর মন্দির ভেঙে ধূলিসাৎ করে দিতে হয়। তখন আমরা বাস করব সাধারণ পশুর মতো ইন্দ্রিয়ের জগতে ঘুরে বেড়িয়ে। আর আত্মা যদি শাশ্বত ও অমর না-ই হয়, তবে ধর্মজীবন যাপন কিংবা ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদান করারই বা যৌক্তিকতা কোথায় ?

দেহ-সম্পর্কহীন পৃথক আত্মার সত্তা

দেহ-সম্পর্কহীন পৃথক আত্মার সত্তা যারা বিশ্বাস করে না, নৈতিক প্রশ্নের সমস্যা তাদের কাছে এসে দাঁড়াবেই। মনোবিজ্ঞানের বেলায়ও তাই। আত্মা বা মন সম্বন্ধে জীর্ণ বস্তুতান্ত্রিক মতবাদ তো একরকম অচল বললেই হয় ; তাছাড়া এই মত ধীমানের কাছে কোনদিনই আদরণীয় নয়।

আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে মস্তিষ্কের চির-সক্রিয়তা এবং আত্মসচেতনতা বিষয়ের ব্যাখ্যা করা দুরূহ। কোন শক্তি, ভাবনা, কল্পনা ও স্মৃতিশক্তির সৃষ্টি করে তা বোঝা যাবে না। জীবের যে দর্শন শ্রবণ স্পর্শনের অনুভূতি তা কি ইথারের স্পন্দনের দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে? কোন ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে কি ঐসব সৃষ্টি করা যায় ? এটি অসম্ভব, অসাধ্য। কেউ কখনও তা দেখেনি। তাই একমাত্র আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করলে ঐসব সমস্যার সমাধান হতে পারে।

জড়বস্তুর কিংবা তড়িৎ পদার্থ থেকে চৈতন্যের সৃষ্টি হয়নি। সারা বিশ্ব-সৃষ্টিকে বিশ্লেষণ করলে এই তিনটি আদিম ও মৌলিক বস্তুই পাওয়া যাবে : প্রথম, পদার্থ ; দ্বিতীয়, জ্ঞান বা শক্তি ; তৃতীয়, চৈতন্য। এগুলির মধ্যে মূলপদার্থ অপরিবর্তনীয় ও অক্ষয়। মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা থেকেও জানা গেছে যে, পদার্থ বা শক্তি কারও দ্বারা কোনদিন সৃষ্টি হয়নি। পদার্থ অক্ষয় ও অসৃজনীয়। বস্তুত পদার্থ ও শক্তি চৈতন্য-সংরক্ষিত হয়েই চলতে থাকে। পদার্থ ও শক্তিসংরক্ষণ যদি সত্য হয় তবে সাধারণতই প্রশ্ন ওঠে যে, কেমন ক’রে তৃতীয় পদার্থটি, যার মাধ্যমে আমরা জগতের সকল-কিছুর জ্ঞানলাভ করি, তাও কেন সংরক্ষিত হয় না ? পদার্থ-জ্ঞান সংরক্ষিত হ’লে তারাও শাশ্বত ও অপরিণামী হিসাবে গণ্য হবে।

আমরা সকল-কিছু পদার্থকে জানি একমাত্র চৈতন্য বা বুদ্ধির মাধ্যমে। এদের ছাড়া আর কোন শক্তির সাহায্যে কি আমরা তাদের জানতে পারি পদার্থ ও শক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞতাও আমাদের জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে। আসল কথা এই যে, পদার্থ ও শক্তি সংরক্ষিত ও শাশ্বত হ’লে আমাদের জ্ঞানও শাশ্বত ও সংরক্ষিত হবে : অর্থাৎ যদি পদার্থ প্রভৃতি বস্তু সংরক্ষিত ও অক্ষয় হয়ে থাকতে পারে তো চৈতন্যেরও তা হ’তে বাধা কি?

মনে রাখা উচিত যে, সৃষ্টির অর্ধেকটা পদার্থ ও জ্ঞান নিয়ে বাস্তব বিশ্ব, আর বাকী অর্ধেকটা চৈতন্যময় বিশ্ব। আমরা যদি মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে যাই তো কোন-কিছুরই সত্তা আমাদের কাছে থাকবে না। আমাদের কাছে সবকিছুরই প্রতীতি ও অনুভূতি চৈতন্যের জন্য।

একথা তাহলে বেশ স্পষ্টই বোঝা যায় যে, বস্তু ও জ্ঞানের সত্তা নির্ভর করে ব্যক্তিচেতনার ওপর। সুতরাং পদার্থ কিংবা জ্ঞানের সংরক্ষণ হ’তে হ’লে ব্যষ্টি চেতনারও সংরক্ষণ হ’তে হয়। বিশ্বের বিষয়গুলি বিশ্লেষণ ক’রে মূলনীতির কথা অবগত হ’লে বোঝা যাবে যে, পদার্থ ও জ্ঞানের মতো বুদ্ধি চৈতন্য সংরক্ষিত হয়, আর তা যদি হয় তো ব্যক্তিচৈতন্যও সংরক্ষিত না হয়ে যায় না। কাজে কাজেই সকল চৈতন্যের আধার ও উৎস যে আত্মা তা স্বীকার করতে হয়, করলে সব ঝামেলাও চুকে যায়। পদার্থ থেকে আত্মার সৃষ্টি হয় না, কারণ পদার্থ পদার্থকেই সৃষ্টি করতে পারে। নিউটন মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করেছিলেন কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ কখনও নিউটনকে আবিষ্কার করেনি।

কিন্তু আত্মার অমরত্বের কথা মেনে নিলেও দেহ যে পরিবর্তনশীল তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাহলে আত্মার স্থায়িত্ব দেহের মধ্যে নেই একথা বোঝা যাচ্ছে। তবে স্থায়িত্ব কিসের ? সে স্থায়িত্ব হবে আত্মার বা আত্মচেতনার। এই আত্মচেতনাই টিকে থাকে দেহ ক্ষয় হয়ে যাবার পরও।

আত্মার অবিচ্ছিন্নতা ও নিত্যতা স্বীকৃত না হয় হ’ল, কিন্তু এর লক্ষ্য বা গন্তব্য কি? আধুনিক বিজ্ঞান এর জবাব দিতে পারে না। উত্তর দেওয়া অতো সহজও নয়। এই বিষয়ে বেদান্তের উত্তর সর্বজনগ্রাহ্য ও সর্বপ্রকার সংকীর্ণতাবর্জিত। বেদান্তের মতে, আত্মা যে স্থুল জড়দেহ উৎপন্ন করে তা হ’তে আত্মা ভিন্ন, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। এই আত্মার মধ্যেই আছে প্রাণশক্তি, মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়শক্তি। এই আত্মাই পিতামাতার মাধ্যমে দেহ সৃষ্টি করে।

এখন প্রশ্ন এই যে, আত্মা যদি মরণের পরেও থাকে তো তার ব্যক্তিত্ব বা বৈশিষ্ট্য থাকে—না যায় ? বেদান্তের মতে, তার বৈশিষ্ট্য থাকে। দেহান্তে আত্মা বুঝতে পারে কোথায় সে ছিল, কে ছিল তার জনক-জননী।

আত্মার ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ

আধুনিক অধ্যাত্মতত্ত্ব মরণের পর আত্মার ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্বের কথা প্রমাণ করেছে। আধ্যাত্মিক জীবনে যাঁরা অগ্রসর হয়েছেন তাঁরা পার্থিব সম্পর্কের কথা ভেবে মুহ্যমান হন না, তাঁরা আরো উন্নত অবস্থায় যেতে ইচ্ছা করেন। আত্মারা তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য রক্ষা ক’রে যে-কোনও লোকে যেতে পারে। তারা দেবদূতদের কাছেও যেতে পারে, স্বর্গেও যেতে পারে। বেদান্তের মতে—স্বর্গ অনেক আছে। স্বর্গ বলতে বোঝায় এমন এক অস্তিত্ব বা লোক যেখানে আমরা জীবনের সুখ উপভোগ করতে যাই। কিন্তু যাঁরা উচ্চস্তরের অধ্যাত্মজীবন কামনা করেন তাঁরা অনন্ত ও অখণ্ড ব্রহ্মের সঙ্গে না মিশে-যাওয়া অবধি কেবলই চলতে থাকেন।

স্বর্গ-সম্বন্ধে খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের অভিমত একরকম। এই মতে স্বর্গ হচ্ছে অনন্ত সুখ ও গৌরবের স্থান। ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণদের জন্যই এই স্থান। আর নরক হচ্ছে, দুরাত্মাদের চিরকালের মতো শাস্তির ও কষ্টের স্থান। বেদান্তের মতে কিন্তু তা নয়। বেদান্তের মতে, যেসব আত্মার পার্থিব সামগ্রীর কামনা আছে, মর্ত্যে তাদের ফিরে আসতেই হবে। মানবাত্মার লক্ষ্য তাঁর চিন্তা-ভাবনা কামনাবাসনার দ্বারা নিরূপিত হয়। আসলে ভাবনা-কামনা দ্বারাই আমরা আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করি। আমাদের বর্তমান সত্তা আমাদের অতীতের আশা-লালসা ও জীবনের কর্মময় পরিণতি। ঈশ্বর আমাদের অবস্থার জন্য দায়ী নন, দায়ী আমরা নিজেরা। জীবনের এই মূলসূত্রটি জানলে আমরা ভাবী ক্রমোন্নত অবস্থায় উপনীত হবার জন্য চেষ্টা করতে পারি। মোটকথা, আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই, এই হচ্ছে বেদান্তের একটি সিদ্ধান্ত।

যাঁরা সৎ ও মহৎ কাজ ক’রে ধার্মিকের জীবনযাপন করেন তাঁদেরও ফিরে এসে জন্ম নিতে হয় এই ধরণীতে। অবশ্য তারপর তাঁরা উন্নত ও মহত্তর চিন্তাভাবনা দ্বারা উচ্চস্তরে উঠে যাবার পথ ক’রে নিতে পারেন। যাদের রীতিপ্রকৃতি নীচ ও ইতর, তাদের জন্ম নিতে হবে জড়বুদ্ধি মানুষরূপে। যতদিন না তাদের মধ্যে জাগছে মহদ্ভাবনা ও দিব্যচিন্তা, ততদিন তাদের থাকতে হবে এই মর্ত্যে। মহত্তর ভাবনার উন্মেষণা ও সাধনার দ্বারা তারা অবশ্য শ্রেষ্ঠ লোকের পথে যাত্রা করতে পারে।

সুতরাং বেদান্তের সিদ্ধান্ত ও পথনির্দেশ অনুযায়ী আমরা পরিষ্কার একটা ধারণা করতে পারি—কি আমাদের জীবনে পালনীয় ও করণীয়, কি করলে আমরা চরমলক্ষ্যে, পরমতম পরিণতিতে পৌঁছতে পারি। আশা ও বিশ্বাস নিয়ে সৎ ও মহৎ কাজ ক’রে এবং আমাদের চরিত্র গঠন করে আমরা শাশ্বত সুখ-শান্তিআনন্দের অধিকারী হ’তে পারি।

তথ্যসূত্র:
১| স্বামী অভেদানন্দ: ‘আত্মজ্ঞান’, পৃষ্ঠা: ১৭-১৮ |
২| স্বামী অভেদানন্দ:Path of Realisation পৃষ্ঠা: ১৭৩-৯৮