Swami Vivekananda on concentration: বিবেকানন্দ তার আদর্শ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, সবার আগে প্রয়োজন মানবজাতিকে তার অন্তর্নিহিত দেবত্ব শিক্ষা দেওয়া এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তা কিভাবে কাজে লাগাতে হয় তা শেখানো।
তিনি মনে করতেন, সমসাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা যে মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে না, বা মানুষের মধ্যে আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে না, তা খুব বেদনার বিষয়।
সাফল্যের মূলে আছে এই একাগ্রতা (concentration)
তিনি দেখেছেন মানুষের মধ্যে আত্মনির্ভরতা আত্মমর্যাদাবোধ এর মূলে আছে একাগ্রতা। যে একাগ্রতাবোধ মানুষকে অন্যান্য জীব জন্তুর থেকে আলাদা করে তোলে। এ সম্পর্কে স্বামীজি বলেছেন-
“মানুষ ও পশুর মধ্যে প্রধানতম পার্থক্য হল মন একাগ্র করার ক্ষমতার তারতম্যে। যে কোনাে কাজে সাফল্যের মূলে আছে এই একাগ্রতা(concentration)। তাই একাগ্রতার সঙ্গে আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর পরিচয় আছে। এর ফল প্রতিদিনই আমাদের চোখে পড়ে। সঙ্গীত, কলাবিদ্যা প্রভৃতিতে আমাদের যে উচ্চাঙ্গের কৃতিত্ব, তা এই একাগ্রতাপ্রসুত। একাগ্রতার ক্ষমতা পশুদের এক রকম নেই বললেই চলে।
যারা পশুদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন তাদের বিশেষ বেগ পেতে হয় । কারণ পশুর মধ্যে একাগ্রতা না থাকায় তাকে যা শেখানাে হয় তা সে ক্রমাগত ভুলে যায়। কোনাে বিষয়ে একসঙ্গে বেশীক্ষণ মন দেবার ক্ষমতা তার নেই। আর পশুর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য এইখানেই । মন একাগ্র করার ক্ষমতা পশুর চেয়ে মানুষের অনেক বেশী। আবার মানুষে মানুষে এই একাগ্রতারও তারতম্য দেখা যায়। সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে সর্বোচ্চ স্তরের মানুষের তুলনা করলে দেখা যাবে একাগ্রতার মাত্রার বিভিন্নতাই এই পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। আর এটাই হল মূল পার্থক্য।”
সকলেরই মন সময়ে সময়ে একাগ্র হয়ে যায়। যা আমাদের প্রিয় তারই ওপর আমরা সকলে মনােনিবেশ করি। আর যে বিষয়ে মনােনিবেশ করি তাই-ই প্রিয় হয়ে ওঠে। এমন মা পৃথিবীতে নেই, যিনি তাঁর ছেলের অত্যন্ত সাধারণ মুখখানিও ভালােবাসেন না। মায়ের কাছে তাঁর ছেলের মুখখানিই জগতের সুন্দরতম মুখ। মন সেখানে নিবিষ্ট করেছেন বলেই তাে মায়ের কাছে ছেলের মুখখানি প্রিয় হয়েছে। সকলেই যদি সেই মুখখানির ওপরে মন বসাতে পারত তাহলে তার ওপর সকলের ভালােবাসা জন্মাত। সকলেই ভাবত, এমন মুখ আর হয় না।
দ্রুতলয়ের সংগীত শোনামাত্র মন তাতে আকৃষ্ট হয় কেন?
যা ভালোবাসি তারই ওপর আমরা মনোনিবেশ করি। সুললিত সঙ্গীত শােনার সময় আমাদের মন সেই সঙ্গীতেই আবদ্ধ হয়ে থাকে। তা থেকে আমরা মনকে সরিয়ে নিতে পারি না। উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত বলে যা পরিচিত, তাতে যাদের মন একাগ্র হয়, সাধারণ পর্যায়ের সঙ্গীত তাদের ভালো লাগে না। আবার এর বিপরীতটিও সত্য। দ্রুতলয়ের সংগীত শোনামাত্র মন তাতে আকৃষ্ট হয়। ছেলেরা হালকা সংগীত পছন্দ করে। কারণ তাতে লয়ের দ্রুততা মনকে বিষয়ান্তরে চলে যাওয়ার কোনো অবকাশই দেয় না। উচ্চাঙ্গের সংগীত জটিলতর।তা অনুধাবন করতে হলে অধিকতর মানসিক একাগ্রতার প্রয়ােজন। সেই জন্যেই সাধারণ সঙ্গীত যারা ভালোবাসে উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত তাদের ভালো লাগে না।
মন আমাদের চালিত করে ?
এই ধরণের একাগ্রতার সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে, মন আমাদের আয়ত্তে থাকে না। বরং মনই আমাদের চালিত করে। যেন সম্পূর্ণ বাইরের কোনাে বস্তু আমাদের মনটিকে টেনে নিয়ে যতক্ষণ খুশি নিজের কাছে ধরে রাখে। সুমধুর সঙ্গীত শােনার সময় অথবা মনােস্কা ছবি দেখার সময় আমাদের মন তার মধ্যে দৃঢ়ভাবে সন্নিবেশিত হয়ে যায়। মনকে তখন আমরা সেখান থেকে তুলে আনতে পারি না।
চেষ্টার মাধ্যমে একাগ্রতাকে ইচ্ছামতাে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ?
আবার আমি যখন আপনাদের মনের মতো কোনাে বিষয়ে সুন্দর বক্তৃতা দিই তখন আমার কথার মধ্যে আপনাদের মন একাগ্র হয়। আপনাদের কাছ থেকে আপনাদের মনকে কেড়ে এনে আমি আপনাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তাকে ওই প্রসঙ্গের মধ্যে ধরে রাখি। ঠিক এই ভাবে আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বহু বিষয়ে মন আকৃষ্ট হয়ে একাগ্র হয়। আমরা তাতে কোনাে মতেই বাধা দিতে পারি না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চেষ্টার মাধ্যমে এই একাগ্রতাকে বাড়িয়ে তােলা ও ইচ্ছামতাে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কি না। যােগীদের মতে তা সম্ভব। তাঁরা মনকে সম্পূর্ণ বশে আনতে পারেন। নৈতিক দিক থেকে একাগ্রতার ক্ষমতা বাড়িয়ে তােলার বিপদও আছে। কোনাে বিষয়ে মন একাগ্র করার পর ইচ্ছামাত্র সেখান থেকে সে মনকে তুলে নিতে না পারলেই বিপদ । এই প্রকার পরিস্থিতি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক । মনকে তুলে নেওয়ার অক্ষমতাই আমাদের সমস্ত দুঃখের কারণ। কাজে কাজেই একাগ্রতার শক্তি বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই মনকে তুলে নেবার শক্তিও বাড়াতে হবে। কেবল বস্তুবিশেষে মনােনিবেশ করতে শিখলেই চলবে না। প্রয়ােজন হলে মুহূর্তের মধ্যে সেখান থেকে মনকে সরিয়ে নিয়ে বিষয়ান্তরে তাকে নিবিষ্ট করতেও পারা চাই। এই উভয় ক্ষমতা সমভাবে অর্জন করতে পারলে বিপদের কোনাে সম্ভাবনাই থাকে না।
কেবল তথ্য সংগ্রহ করা শিক্ষার প্রাণ নয়
এটাই মনের প্রণালীবধ কুমােন্নতি? আমার মতে মনের একাগ্রতা সাধনই শিক্ষার প্রাণ। কেবল তথ্য
সংগ্রহ করা শিক্ষার প্রাণ নয়। আবার যদি আমাকে নতুন করে শিক্ষা লাভ করতে হত এবং নিজের ইচ্ছামতে আমি যদি তা লাভ করতে পারতাম তাহলে আমি শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতাম না। আমি আমার মনেরএকাগ্রতা ও নির্লিপ্ততার ক্ষমতাকেই একটু একটু করে বাড়িয়ে তুলতাম । তারপরে ওইভাবে নিখুঁত যন্ত্রের সাহায্যে খুশিমতাে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতাম। মনকে একাগ্র ও নিলিপ্ত করার ক্ষমতা বৃদ্ধির শিক্ষা শিশুদের একই সঙ্গে দেওয়া উচিত।
আমার সাধনা বরাবর একমুখী ছিল। ইচ্ছামতাে মনকে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন না করেই আমি একাগ্রতার শক্তি বাড়িয়ে তুলেছিলাম। আর এটাই হয়েছে আমার জীবনে দারুণতম দুঃখের কারণ। এখন আমি খুশিমতাে মনকে তুলে নিতে পারি। তবে এটা আমাকে শিখতে হয়েছে আরও অনেক পরে।
কোনাে বিষয়ে ইচ্ছামতাে আমরা নিজেরাই যেন মনােনিবেশ করতে পারি। বিষয় যেন আমাদের মনকে টেনে না নেয়—সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। সাধারণত বাধ্য হয়েই আমরা মনােনিবেশ করি। বিভিন্ন বিষয়ের আকর্ষণের প্রভাবে আমাদের মন সেখানে সংলগ্ন হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। আমরা তাকে কোনাে মতেই বাধা দিতে পারি না। মনকে সংযত করতে হলে অর্থাৎ যেখানে ইচ্ছা করব ঠিক সেখানেই মনকে নিবিষ্ট করতে হলে বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন। অন্য কোনাে উপায়ে তা হবার নয়। ধর্মের অনুশীলনে মনঃসংষম একান্ত প্রয়োজন । এ অনুশীলনে মনকে ঘুরিয়ে মনেরই ওপর নিবিষ্ট করতে হয় ।
মনের নিয়ন্ত্রণ আরম্ভ করতে হয় প্রাণায়াম থেকে
মনের নিয়ন্ত্রণ আরম্ভ করতে হয় প্রাণায়াম থেকে। নিয়মিত শ্বাসক্রিয়ার ফলে দেহে সমতা আসে। আর তখনই মনকে ধরা সহজ হয়। প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হলে প্রথমেই আসন বা দেহসংস্থানের কথা ভাবতে হবে। যে ভঙ্গিতে খুব সহজে বসে থাকা যায় তাই ই হল উপযুক্ত আসন। মেরুদণ্ড যেন ভারমুক্ত থাকে। দেহের ভার যেন বুকের ওপর রাখা হয়। কোনাে স্বকপােলকল্পিত কৌশল অবলম্বনে মন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিত নয়। একমাত্র সহজ, সরল শ্বাস-প্রক্রিয়াই এ পথে যথেষ্ট। নানা প্রকার কঠোর সাধনের সাহায্যে মনকে একগ্র করতে প্রয়াসী হলে ভুল করা হবে। সে সব না করাই ভালাে।
মন শরীরের ওপর কাজ করে। আবার শরীরও মনের ওপর ক্রিয়াশীল। উভয়েই পরস্পরের ওপর ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া করে থাকে । প্রত্যেক মানসিক অবস্থার অনুরপ অবস্থা শরীরে ফুটে ওঠে । আবার শরীরের প্রতিটি ক্রিয়ার অনুরুপ ফল প্রকটিত হয় মনের ক্ষেত্রে। শরীর ও মনকে দুটো আলাদা বস্তু বলে মনে করলেও কোন ক্ষতি নেই। আবার দুটো মিলে একটাই শরীর অর্থাৎ স্থূল অংশ, আর মন তার সূক্ষ্ম অংশ এমন ভাবলেও কিছু আসে যায় না। কারণ এরা পরস্পর পরস্পরের ওপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীল মন প্রতিনিয়ত শরীরে রপায়িত হচ্ছে। মনকে সংযত করতে হলে প্রথমে শরীরের দিক থেকে আরম্ভ করা বেশী সহজ। মন অপেক্ষা শরীরের সঙ্গে সংগ্রাম করা অনেক সহজ কাজ।
মনই স্নায়ুমণ্ডলীর নিয়ন্তা ও অধীশ্বর।
যে যন্ত্র যত বেশী সূক্ষ্ম, তার শক্তিও তত বেশী। মন শরীরের চেয়ে অনেক বেশী সূক্ষ্ম। তাই মন অধিকতর শক্তিসম্পন্ন। আর
এই কারণেই শরীর থেকে আরম্ভ করলে কাজ অনেক সহজ হয়। প্রাণায়াম হচ্ছে এমন একটা বিজ্ঞান, যার সাহায্যে শরীর অবলম্বন করে অগ্রসর হয়ে মনের কাছে পৌছনাে যায়। এভাবে চলতে চলতে শরীরের ওপরে আধিপত্য আসে। তারপর শরীরের সূক্ষ্ম ক্রিয়াগুলো অনুভূতিতে আসামাত্র সেগুলাে আয়ত্তে আসে। কিছুকাল পরে শরীরের ওপর মনের কাজগুলােও অনুভব করা যাবে। মনের একাংশ যে অপরাংশের ওপর কাজ করছে তাও বােঝা যাবে। এবং মন যে স্নায়ুকেন্দ্রগুলােকে কাজে লাগাচ্ছে তাও অনুভব করা যাবে । কারণ মনই স্নায়ুমণ্ডলীর নিয়ন্তা ও অধীশ্বর। বিভিন্ন স্নায়ু স্পন্দনকে অবলম্বন করে মনই যে ক্রিয়া করছে তাও বােঝা যাবে। নিয়মিত প্রাণায়ামের ফলে অর্থাৎ প্রথমে স্থূল শরীরের ওপর ও পরে সূক্ষ্ম, শরীরের ওপর আধিপত্য বিস্তারের ফলে মনকে আয়ত্তে আনা যায়।
প্রাণায়ামে প্রথম ক্রিয়াটি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও খুবই স্বাস্থ্যকর। এর অভ্যাসে আর কিছু না হােক সুস্বাস্থ্য লাভ ও শরীরের সাধারণ অবস্থার উন্নতি হবেই। বাকী প্রক্রিয়াগুলাে আবার একটু একটু, করে সাবধানে করতে হবে।।