The God and soul-Swami Vibekananda: ভগবান ও আত্মা : ১৯০০ খৃষ্টাব্দের ২৩শে মার্চ সানফ্রানসিঙ্কো শহরে দেওয়া বক্তৃতা

The God and soul
The God and soul

The God and soul1900 খ্রিস্টাব্দে ২৩ শে মার্চ সান ফ্রান্সিসকোতে স্বামীজি প্রদত্ত বক্তৃতাতে ভগবান ও আত্মা ও তার রহস্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। যে বক্তৃতাটি আমাদেরকে আদর্শের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পথ দেখায়। স্বামীজির বক্তৃতা এর বাংলা অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হলো:-

Whatsapp গ্রুপে যুক্ত হন
Telegram গ্রুপে যুক্ত হন

“ভয় কিংবা কৌতূহল যা কিনা মানুষকে সবচেয়ে আগে তার নিজের চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী বিষয়ে ভাবাতে শুরু করেছিল- সেটা আমাদের আলোচনা করার দরকার নেই। এই ভাবনাগুলো থেকে মানুষের মনে বিশেষ বিশেষ আরাধনার শুরু হয়েছে । এমন কোনো সময় মানুষের ইতিহাসে বের করা যাবে না যখন একটা না একটা আদর্শ ছিল না। কেন, কি কারণে আমরা ইন্দ্রিয়গোচর বস্তুর বাইরের কোনো কিছুকে বোঝার জন্যে এত আকুল হই ?

মৃত মানুষের আত্মার ভয় কিংবা অপূর্ণ একটা সকালের ছোঁয়া কিসের জন্যে আমরা অনুভব করি ইন্দ্রিয়াতীত এক আবেশ ? ইতিহাসের যুগ ছাড়িয়ে আরো পিছনে যাওয়ার দরকার নেই, কেননা এই ব্যাপারটা ২ হাজার বছর আগেও যেমন ছিল, আজও আছে তেমনি। এখানে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। বিশাল ক্ষমতা এবং টাকা পয়সা যতই থাক, সব অবস্থাতেই কিসের যেন একটা অভাব আমাদের অস্থির করে।

Swami Vibekananda Thoughts about The God and soul

বাসনার শেষ নেই। কিন্তু তার সাধ মেটাটা খুবই সীমাবদ্ধ । চাওয়ার তো শেষ নেই আমাদের। কিন্তু চাই যা—তা যখন পেতে যাই তখনই এসে দাঁড়ায় সঙ্কট। আদিকালের মানুষের বেলাতেও এই রকম ছিল। তার চাহিদা ছিল যদিও খুব কম, তব, সেটা সে মেটাতে পারত না। এখন মানুষের শিল্প-বিজ্ঞানে এত উন্নতি সত্ত্বেও আমাদের চাহিদা মিটছে না। একপাশ থেকে আমরা চাহিদা মেটাবার উপায়গলোকে আরো শানাচ্ছি আর একপাশ থেকে চাহিদাও দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছে।

মানুষ তার আদিম অবস্থায় যে সব জিনিস নিজে করতে পারত না তার জন্যেই সে চাইত বাইরের সহায়তা।—বাসনা জেগেছে কোনো কিছুর জন্যে অথচ সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাকে খজতে হত বাইরের শক্তির সাহায্য। ঈশ্বরের কাছে মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্যে আজকের সভ্য মানুষ আর সেদিনকার আদিম মাননুষের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। তফাৎ আছে কি? হয়তো কারো কারো মতে অনেক তফাৎ। কিন্তু আমার মনে হয় সে ধারণাটা ঠিক নয়। বিভেদ ভেবে নেওয়াটা বহু ক্ষেত্রেই নেহাৎ আমাদের বানানো। আদিম মানুষ বা আজকের সভ্য মানুষ যে একই শক্তির কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে তাকে ভগবান আল্লা বা জিহোভা যা খুশি বলা যেতে পারে। মানুষ কিছু আকাঙ্ক্ষা করে সেটা নিজের ক্ষমতায় যখন জোটাতে পারে না তখন কোনো একজনের সাহায্য খোঁজে। এ পৃথিবীতে আমরা সকলেই প্রথমে আসি আদিম অসভ্য হয়ে, তারপর আস্তে আস্তে পরিশীলিত করি নিজেকে।

আরো পড়ুন : [Soul and Peace : আত্মা ও তার অদৃষ্ট : স্বামী অভেদানন্দ]

বড় বড় বুলি , দার্শনিক খ্যাতি যতই আমাদের থাক, ঘা খেলে বুঝতে পারি আসলে কত দুর্বল আমরা, সাহায্যটা আমাদের কতটা জরুরী। তখন সব রকমের কুসংস্কারই আমরা বিশ্বাস করতে থাকি। যদিও সব কুসংস্কারের ভেতরেই কিছু না কিছু , সত্যির ভিত আছে মুখের সবটকু ঢেকে কেবল নাকের ডগাটুকু দেখালেও সেটা মখেরই একটা অংশ। কুসংস্কারও এই রকম একটা বড় জিনিসের অংশ। কোনো বড় সত্যের ছোট টুকরোও ফেলনার নয়। মরা মাননুষকে কবর দেওয়া থেকেই ধর্ম’র গোড়াকার প্রকাশ। প্রথমে মৃতদেহ কাপড় জড়িয়ে ঢিবিতে রাখা ; এই বিশ্বাসে যে আত্মা এসে ওই ঢিবিতে থাকবে। তারপর কবর দেওয়া শুরু হলে বিশ্বাস দাঁড়াল-হাজার দাঁতওয়ালা এক ভয়ঙ্কর দেবী এসে কবরের ফটকে খাড়া হয়েছেন। … এরপর মৃতদেহে আগুন দেওয়া থেকে বিশ্বাস চালু , হল যে চিতার আগুন আত্মাকে উঁচুতে নিয়ে যায়…… মিশরীয়রা মরা মানুষের জন্যে খাদ্য এবং জল নিয়ে যেত।

ইহুদি জাতির দেবতা জিহোভা

এরপর এলো গোষ্ঠী দেবতা। এক এক গোষ্ঠীর এক এক দেবতা। ইহহুদি জাতির দেবতা জিহোভা আর সব গোষ্ঠীর উপাস্য দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন। তিনি তাঁর ভক্তদের জন্যে সব কিছু করতেন। নিজের অনুগামীদের জন্যে অন্য দেবতার অনুগামী জাতিকে ধ্বংস করাও অন্যায় মনে করা হত না। তিনি যেটুকু দয়া দেখাতেন তা একটি ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠীর বাইরে যেত না। এরপর ক্রমিক উচ্চ আদর্শে— দেখা গেল বিজয়ী দলের নেতাকে জায়গা দেওয়া হচ্ছে সব নেতার ওপরে। তিনি দেবতাদের দেবতা । মিশর জয়ের সময় পারস্যের মানুষেরা পারস্য সম্রাটকে এই রকম মনে করত। কেউ তাঁর সমান নন। সম্রাটের দিকে তাকালেও অপরাধে গর্দান যেত ।

পরম শক্তির আধার ঈশ্বরের চিন্তা এর পরে দেখা গেল। তিনি সমস্ত ক্ষমতার আশ্রয়, তিনি সব জানেন। তিনি জগৎ-পালক ৷ তিনি থাকেন স্বর্গে । মানুষ বিশেষ ভাবে তাঁকে আরাধনা করে, তাঁকে সবচেয়ে প্রিয় মনে করে কেননা তাঁর সব কিছু সৃষ্টি মানুষের জন্যেই । চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা মানুষের জন্যে। মানুষের ভোগের জন্যে তিনি রচনা করেছেন গোটা পৃথিবীটা।

গঙ্গা আর ইউফ্রেটিস নদীর মাঝের ভূভাগে বিকশিত হয়েছে উঁচু মানের ধর্মগুলো

এই ধরণের চিন্তা যাদের, বুঝতে হবে তাদের ধারণা এখনো আদিম স্তরে রয়েছে। একে সভ্য ও পরিশীলিত বলা যায় না। গঙ্গা আর ইউফ্রেটিস নদীর মাঝের ভূভাগে বিকশিত হয়েছে উঁচু মানের ধর্মগুলো। স্বর্গে থাকা ঈশ্বর ছাড়া আর বেশি কিছু , ধর্মের গভীর বোধ আমরা ভারতের বাইরে দেখতে পাই না। ঈশ্বর-বিশ্বাসীরা মরার পর স্বর্গবাসী ঈশ্বরের কাছে যাবেন—এ ধারণাটা অত্যন্ত আদিম। এই স্বর্গের পিতা আর আফ্রিকার মাম্বো-জাম্বো একই কথা। তিনি জগৎকে চালাচ্ছেন। সর্বত্র তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হচ্ছে।

স্বৰ্গকে মানত না প্রাচীন হিব্রুরা

স্বৰ্গকে মানত না প্রাচীন হিব্রুরা। যীশু মৃত্যুর পর জীবনের কথা বলতেন বলে তারা যীশু -কে মানত না। সংস্কৃততে স্বর্গলাভের অর্থ পৃথবীর অতীত জায়গা। সুতরাং পৃথিবীর যা কিছু অশুভ তা শুধরে নেওয়ার জায়গা হল স্বর্গ। অশুভকে পাত্তা দিত না আদিম মানুষ। সে প্রশ্ন তুলত না অশুভ কেন থাকবে ?

শয়তান শব্দটা পারস্যের। আর্যদের ধ্যান-ধারণার উত্তরাধিকার বহন করছে পারসীক ও হিন্দুরা। ওদের ভাষাতেও ছিল মিল, কিন্তু এক ভাষার শুভগুলো অন্য ভাষায় বোঝাত অশুভ। প্রাচীন সংস্কৃতের দেব শব্দটার মানে ঈশ্বর আর পারসীক ভাষায় তার মানে ‘শয়তান’ ।

ঈশ্বর কথিত হলেন মঙ্গলময় রূপে

এরপর মাননুষের ধর্মচিন্তা আরো উন্নত হলে ধর্ম বিষয়ক নানা প্রশ্ন জাগল । ঈশ্বর কথিত হলেন মঙ্গলময় রূপে। পারসীরা মনে করে বিশ্বসংসারের মালিক দুজন-শভ ও অশুভ ।

গোড়ায় ছিল সব কিছই শুভ, সুন্দর। চিরবসন্ত বিরাজমান ভূমি, অমর জীবন ও রোগহীন শরীর। এর পর এলো অশুভ । এ আসার সঙ্গে সঙ্গে এলো রোগ-শোক। এলো বাঘ সিংহের মতো ক্ষতিকারক এবং হিংস্র জন্তু। তারপর আর্যরা পিতৃভূমি ছেড়ে এগিয়ে গেল দক্ষিণ দিকে।

শয়তানের ধারণা

শয়তানের ধারণা ইহদিরা পেয়েছে পারসীকদের কাছ থেকে। পারসীকরাও বলত একদিন এই অশুভর বিনাশ হবে। আমাদের কাজ হল অশুভর সঙ্গে অবিরত লড়াই করে শুভ ঈশ্বরের শক্তি বাড়ানো।···সারা পৃথিবী পুড়ে ছাই হবে এবং সকলেই পাবে নতুন শরীর ।

খারাপ মানষেরাও একদিন শুদ্ধ হবে এবং তাদের মধ্যেও আর অশুভ থাকবে না—এ ধারণা ছিল পারসীকদের। কোমল ও স্নেহময় কবিপ্রাণ প্রকৃতি ছিল আর্যদের। তাই তারা চিরকাল নরকের আগুনে পোড়ার কথা ভাবতে পারত না। মরণের পর নতুন দেহ হবে মাননুষের, আর মরণ হবে না। ভারতের বাইরে ধর্মসাধনা এটাই সবচেয়ে উঁচু চিন্তা । তার সঙ্গে আছে নীতিকথা । চিন্তা, কাজ এবং কথায় যাতে মানুষ সৎ থাকতে পারে সেদিকে তার নজর দেওয়া উচিত। এ ধর্ম কাজের ও জ্ঞানের।

শয়তানের অল্প উল্লেখ পাওয়া যায় ভারতের বেদের প্রাচীনতম অংশে। তবে সে ক্ষণস্থায়ী, একবার দেখা দিয়েই আড়ালে চলে গেছে । অশুভর নায়ক এই শয়তান বেদে যেন একটা ঘা খেয়েই পালিয়েছে। শয়তান ভারত থেকে চলে গেলে, তাকে নিল পারসীরা। দুনিয়া থেকে তাকে একেবারে দূর করার চেষ্টা করছি আমরা। পারসীদের ধারণা নিয়ে তাকে একটা সভ্য-ভব্য মানুষ করতে চাই আমরা। নতুন আদল দিতে চাই। শয়তানের ইতিহাস ভারতে এখানেই ইতি।

ঈশ্বর-চিন্তার স্বরূপ

কিন্তু এগিয়ে চলল ঈশ্বর-চিন্তা। ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা বাড়তে বাড়তে যে শেষ পর্যন্ত পারস্যের সম্রাটের ক্ষমতা চূড়ায় গিয়ে ঠেকেছিল—সে ঘটনাটাও প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে।

আরেকদিকে শুরু হল তত্ত্ব ও দর্শন জ্ঞানের। মানুষের ভেতরকার সত্য সম্পর্কে চিন্তার বিকাশ শুরু হল । ভারতবর্ষের বাইরে ঈশ্বরের ধারণা আটকে গেছিল বস্তুর আকারে। এই ধাপটা পেরিয়ে আসতে ভারত কিছুটা সহযোগিতা করেছিল। এখানকার ( আমেরিকার ) লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বাস করে ঈশ্বরের একটা শরীর আছে। তাদের মতে ঈশ্বর জগৎ শাসন করছেন এবং একটি বিশেষ স্থানে স্বশরীরে বিরাজমান। তিনি বসে আছেন সিংহাসনের ওপর। পৃথিবীর মন্দিরের মতো সেখানেও প্রদীপ জলে, সেই রাজার রাজাকে গান শোনানো হয়।

ভারতের সাধক

ভারতের সাধকদের যথেষ্ট জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়, তাঁরা ঈশ্বরকে ওভাবে দেহধারী করে তোলেন নি। ভারতে ব্রহ্মের কোনো মন্দির দেখতে পাবেন না। কেননা সব সময়েই তো ভারতে আত্মা ধারণা ছিল। হিব্রুরা যেমন কখনো আত্মা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে নি। বাইবেলের ‘পূরাতন সমাচারে’ আত্মা নিয়ে কথা নেই । সেটা প্রথম দেখা যায় ‘নতুন সমাচারে’। পারসীরা বরাবর খুব কেজো মানুষ। তারা যুদ্ধপ্রিয় এবং বিজয়ী জাতি। তারা যেন আজকের ইংরেজদের পরোনো সংস্করণ-আশপাশে যে সব জাতি আছে তাদেরকে লড়াই করে শেষ করে দিতে চায়। এই সব নিয়ে তারা এত মেতে থাকত যে তাদের আত্মা নিয়ে ভাবনার সময় ছিল না।

আত্মা স্থুল দেহের ভেতরে একটা সূক্ষ্ম শরীর

আত্মা সম্পর্কে সবচেয়ে পুরানো ধারণা হল এই যে আত্মা স্থুল দেহের ভেতরে একটা সূক্ষ্ম শরীর। সূক্ষ্ম দেহ আবির্ভূত হয় স্থুল দেহ ধ্বংস হলে। মিশরীরা মনে করত যে । সূক্ষ্ম দেহেরও বিনাশ আছে। স্থুল দেহের বিকার ঘটলে তা সূক্ষ্ম দেহকেও প্রভাবিত করে। এই জন্যেই মিশরে পিরামিড গড়া। স্থুল দেহ আরক ইত্যাদির সাহায্যে সতেজ রাখা হত পিরামিডের মধ্যে।

ভারতীয়রা। মৃতদেহের প্রতি ওভাবে নজর না দিয়ে ভাবে, শবটিকে কোথাও নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বাবার মৃতদেহে আগুন লাগায় ছেলে । দেব প্রকৃতির আর অসুর প্রকৃতির—এই দুই প্রকৃতির মানুষ। দেব প্রকৃতির মানুষ নিজেদের চৈতন্যময় আত্মা বলে মনে করে আর অসুর প্রকৃতিরা ভাবে তারা দেহমাত্র। প্রাচীন ভারতের দর্শন বলে দেহের কোনো অপরিণামী সত্তা নেই। পুরানো কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় পরার মতো মানুষের আত্মাও সেই রকম পুরানো দেহ ছেড়ে দিয়ে নতুন দেহ নেয়। আমার বেলায় আমার পরিবেশ ও শিক্ষা আমাকে ভারতীয় আদর্শের ‘উল্টোদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, কেননা আমি সব সময় থাকতাম মুসলমান আর খৃষ্টানদের সঙ্গে। ওরা দেহের দিকে নজর দেয় বেশি।

ঈশ্বর আর আত্মার ধারণা

দেহ্ হল আত্মার পরের ধাপ মাত্র। ভারতে আত্মার আদর্শের ওপর খবে জোর দেওয়া হত। ঈশ্বর আর আত্মার ধারণা এখানে এক হয়ে গিয়েছিল। আত্মার ধারণা আরও এগিয়ে নিলে দেখা যাবে আত্মা নাম ও রূপের ঊর্ধ্বে। ভারতীয় শিক্ষায় আত্মা অবয়বহীন। যারই আকৃতি আছে তারই আছে বিনাশ। আকার পেতে গেলে জড় ও শক্তিকে মেলাতে হবে। আর সমন্বিত বস্তু মাত্রেরই তো বিশ্লেষ হয়ই। তাই আত্মার নাম আর রূপ মেনে নিলে তাকে আর অমর রাখা যায় না, সে মৃত্যুর অধীন হয়ে পড়ে।ভারতের ঋষিরা উপলব্ধি করেছেন আত্মা মন নয়, নয় সূক্ষ্ম দেহধারীও ।

সংযমের মধ্যে আনা যায় চিন্তাধারাকে। মনের এই সংযমকে কত দূর নিয়ে যাওয়া যায় ভারতীয় ঋষিরা তা দেখার জন্যে সাধনা করেছেন । কঠোর সাধনায় নিশ্চল করেছেন চিন্তার গতিকে। মন যদি হয় মানুষের প্রকৃতি-স্বরূপ, তাহলে চিন্তার ওপরে গেলে মানুষের মৃত্যু হবে। চিন্তা লোপ পায় ধ্যানে। মনের উপাদানগুলোও শিথিল হয়ে যায়। রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসও থামে, কিন্তু সাধকের মৃত্যু হয় না। জীবন যদি নির্ভর করত চিন্তার ওপর তাহলে ও রকম অবস্থায় তার দেহ-মনের ধ্বংসই ছিল শ্বাভাবিক। তারা দেখেছেন, পরীক্ষা করেছেন, তারপর সিদ্ধান্তে এসেছেন—মন ও মনের চিন্তাগুলো প্রকৃত মানুষ নয়। মন কখনও মানুষের আত্মা হতে পারে না।

আমার চলা, চিন্তা করা ও কথা বলার মধ্যে একটা ঐক্যসমূত্র আছে। ভাবনা আর কাজের হাজারো রকম আমরা দেখতে পাই, কিন্তু সমস্ত বৈচিত্রের মধ্যে আছে এক পরিবর্তনহীন সত্তা । সেই সত্তা শরীর নয় । দেহ তো প্রতি মুহূর্তে — বদলাচ্ছে। ওটা মনও নয়, কেননা মনেও তো জাগছে নতুন নতুন চিন্তার ঢেউ। এও বলা যায় না ওটা দেহ আর মনের যোগফল। দেহ-মনের যোগফল তো প্রকৃতির অতর্গত আর প্রকৃতি তো নিয়মের অধীন।

সব স্বর্গ, সব পৃথিবী সেই চৈতন্যময় পরুষে অবস্থান করে

তাই যিনি প্রকৃত মানুষ তিনি প্রকৃতির সীমার মধ্যে নন। তার দেহ ও মন যদিও প্রকৃতির অধীন কিন্তু তিনি হলেন পরিবর্তনহীন চৈতন্যময় পুরুষ। তিনি ব্যবহার করছেন প্রকৃতিকে – যেমন এই চেয়ার এই কলম এই কালি ব্যবহৃত হচ্ছে তেমনি। ইনি প্রকৃতির সূক্ষ্ম ও স্থূল আকারকে কাজে লাগাচ্ছেন । দেহ হল স্থুল আকৃতি আর মন হল সূক্ষ্ম আকৃতি। নিজে ইনি নিরাকার, অরূপ, আবার সর্বব্যাপীও। এটা বুঝতে হবে। ধরা যাক টেবিলের ওপর এই গ্লাসটা। গ্লাস একটা আকার আবার টেবিলটাও একটা আকার। এগুলো যখন ভেঙে যায় তখন গ্লাসের গ্লাসত্ত্ব ও টেবিলের টেবিলত্ব অনেকটা চলে যায়। আত্মার কোনো রূপ নেই বলে নামও নেই কোনো। ইনি যেমন এই গ্লাসটার মধ্যে ঢুকবেন না তেমনি না যাবেন স্বর্গে’, না যাবেন নরকে। ইনি যে আধারে থাকেন সে আধারের রূপই নেন। আত্মা যদি স্থানে (স্পেস) না থাকেন তাহলে দুরকম বিকল্প হতে পারে। অন্য পক্ষে তা স্থানে না থাকলে তো স্থানই তাতে থাকবে। সব স্বর্গ’, সব পৃথিবী সেই চৈতন্যময় পরুষে অবস্থান করে ।

ঈশ্বরের বেলাতেও তাই। ঈশ্বর আছেন সব জায়গায়। হাত না থাকলেও তিনি সব জিনিস ধরে থাকেন, পা না থাকলেও সব জায়গায় চলেন তিনি। নিরাকার, মৃত্যুহীন, ও অনন্ত ঈশ্বরের ধারণা গড়ে উঠল। আমার আত্মা যেমন আমার অধীশ্বর তেমনি তিনি সব আত্মার অধীশ্বর। আত্মা দেহ ছেড়ে গেলে দেহের এক মহূর্তও আর বাঁচা সম্ভব নয়—সেই রকম পরমাত্মা যদি আত্মা থেকে চলে যায় তবে আত্মার আর অস্তিত্ব থাকে না। তিনি জগৎ গড়ছেন আবার যা কিছু, ধ্বংস হচ্ছে তাও তাঁরই কর্ম। জীবন ও মৃত্যু দুই তাঁর।

ভারতের সনাতন দার্শনিকরা মনে করতেন :— এই নোংরা দুনিয়া মানুষের যোগ্য নয়। ভালো মন্দ কোনোটাই এখানে চিরস্থায়ী নয়। শয়তান ভারতে বেশী সংযোগ পায় নি সে কথা তো আমি আগে বলেছি। এর কারণ কি? কারণ হল, ধর্ম— ভাবনায় ভারতবাসী খুব সাহসের পরিচয় দিয়েছে। ধর্মের ব্যাপারে তারা অজ্ঞ বালকের মতো আচরণ করতে চায় নি। শিশশুরা যেমন সব সময়ই অপরের ওপর দোষ চাপাতে চায় মানুষও তেমনি বলে—এটা শয়তান আমাকে লোভ দেখিয়ে করিয়েছে-সে-ই এর জন্যে দায়ী। দুর্বল মানুষের এটাই হল ইতিহাস।

মন্দ কেন এলো ? কেন জগৎ হল একটা নোংরা গর্তে’র মতো? এর জন্যে আমরাই দায়ী। আমরাই আগুনে হাত দিয়েছি বলে হাত পুড়েছে। করুণাময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের সহায় হন। তিনি তো নিজেকে আমাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে রাজি।

তোমার দুঃখের জন্য তুমিই দায়ী

এটাই ভারতীয়দের দেখা। তাদের স্বভাবে কাব্যময়তা আছে। তারা কাব্যের জন্যে পাগল। ভারতীদের দর্শনও কবিতা। সংস্কৃত ভাষায় যা কিছু, গভীর ভাবনা তার সবই কাব্যে লেখা। তত্ত্ববিদ্যা নক্ষত্র বিদ্যা সমস্তই কাব্য। তোমার দুঃখের জন্য তুমিই দায়ী। তোমার জীবনের প্রতিটি ঘটনা কারণ পরম্পরায় গাঁথা। তুমিই সব সময় চালাচ্ছ তোমার জীবনকে। তোমার হাতেই তৈরি তোমার জীবনের ছাঁচ। তোমার জীবনের সব গতির জন্যে দায়ী-তুমিই। কাউকে দোষ দিও না। কোনো শয়তানকে আশামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিও না। সেক্ষেত্রে তোমারই শাস্তির মাত্রা বাড়বে।

ভালো বা মন্দ কোনো কাজ করলে তার ক্রিয়া শহর, হয়ে যাবে। সেটা থামানোর জো নেই। তাই এই বাঁধন থেকে ছাড় পাওয়া কঠিন। কার্য-কারণের নিয়মের চেয়ে বেশী শক্তিশালী যদি কেউ থাকেন এবং তিনি যদি আমাদের ওপর প্রসন্ন হন তাহলে তিনি আমাদেরকে এই কর্মচক্রের বাইরে বার করে আনতে পারেন ।

আমরা বলি এই রকম একজন আছেন। তিনি অন্তহীন করণার আধার ঈশ্বর। তিনি আছেন বলেই আমাদের মুক্তি হতে পারে। তুমি কি তোমার নিজের ইচ্ছাতে মুক্ত হতে পারো ? ভগবানের দয়ায় ‘ মুক্তি’–এই কথাটির মধ্যে কি দর্শন আছে ধরতে পারছ কি ? তোমরা পশ্চিমের লোকেরা তীক্ষ. বুদ্ধিসম্পন্ন, কিন্তু দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা করতে গেলেই তোমরা সব কিছুই করে ফেল বেশী রকমের জটিল । মুক্তি মানে যদি প্রকৃতির বাইরে যাওয়া বোঝায় তাহলে তোমরা মুক্তি পাবে কি করে ? মুক্তির মানে হল ঈশ্বরে থাকা । তুমি যদি ‘তোমার’ নিজের আত্মার প্রকৃত স্বরূপ চিনতে পারো-এটা তখনই সম্ভব হবে।

আত্মা প্রকৃতি ও তার সব রকমের বিকার থেকে আলাদা। এই আত্মাই ঈশ্বর, বিশ্বপ্রকৃতি এবং জীবদের মধ্যে ওতপ্রোত ।

একবার প্রকৃতির ফাঁদে আটকিয়ে গেলে আর বার হয়ে আসা যায় না

আমার আত্মার সঙ্গে আমার দেহের যে সম্পর্ক, পরমাত্মার সঙ্গে সব আত্মার সেই রকমের সম্পর্ক। আত্মা, প্রকৃতি আর ঈশ্বর—তিনই এক । কিন্তু আমরা দেখেছি, কার্য-কারণের নিয়ম প্রকৃতির প্রতিটি অংশে ছড়ানো আছে। একবার প্রকৃতির ফাঁদে আটকিয়ে গেলে আর বার হয়ে আসা যায় না। জগতের প্রত্যেকটা মাছির জন্যে হাসপাতাল তৈরি করার সৎকাজেও মুক্তি আসবে না। লোকসেবার এই সব কীর্তি তৈরি হয় আবার ভেঙে যায়। প্রকৃতিতে যিনি কখনো বাঁধা পড়েন নি, যিনি প্রকৃতির অধীশ্বর-নিয়ম তাঁকে চালিত করে না, তাঁর ইচ্ছাতেই নিয়ম চালু, হয়।

সেই চিরস্থায়ী করুণাময়কে ঠিক ঠিক খুজলেই তিনি তোমাকে মুক্ত করবেন, কেননা তিনিই তোমার প্রকৃতি-স্বরূপ।

পরমাত্মা

আমরা পরমাত্মাকে চাই নি বলে তিনি আমাদের উদ্ধার করেন নি। পরমাত্মাকে ছাড়া আমরা সব কিছুকে চাই। তাঁর জন্যে যখন আকুল হয়ে পড়ব, তখনই তাঁকে পাব। স্বাস্থ্য-সম্পদ আর আপদ-বিপদ থেকে বাঁচানোর কথাই আমরা ভগবানকে বলি। কেবলমাত্র তাঁকেই যখন চাইব তখনই দেখা দেবেন তিনি। ভক্ত প্রার্থনা করে-‘সোনারূপো আর অন্যান্য সম্পদের ওপর যেমন ধনীলোকের টান সেই রকম ভালোবাসা যেন তোমার জন্যে আমার হয়। স্বর্গ-মর্তের সুখ, রূপ-যৌবন বা বিদ্যার খ্যাতি-কিছুই চাই না আমি। চাই না মুক্তিও। বার বার যদি নরকে যেতে হয় আমি তাতেও ভীত নই। আমি চাই কেবল তোমাকে ভালোবাসতে-ভালোবাসার জন্যেই ভালোবাসা—যার কাছে স্বৰ্গ কিছুই না।’

মানুষ যা চায়, তাই পায়। সব সময় দেহের ধ্যান করতে থাকলে, আবার দেহধারী হতে হবে। এই দেহটা গেলে আসবে আর একটা
দেহ, একটার পর একটা দেহ নেওয়া চলতে থাকবে। জড়কে ভালো বাসলে জড়েই আটকে থাকতে হবে। গোড়ায় পশু জন্ম । খুব বেশী দেহাসক্তি থাকলে কুকুর বেড়াল হয়ে জন্মাতে হয়। আরো নামলে খনির পাথর হবে আর কিছু নয়। আর এক ধরণের মানুষ আছেন কখনো আপস করতে যাবেন না। মুক্তিপথে যাওয়া যায় সত্যকে ধরেই। এ আর একটা মুলমন্ত্র।

মানুষের যথার্থ আধ্যাত্মিকতার উন্নতির শুরু সেদিন থেকে যেদিন সে শয়তানকে লাথি মেরে দূর করে দিয়েছে। সেদিন সে সাহসের সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সংসারের দুঃখ কষ্টের ভার নিজেরই কাঁধে নিয়েছে। তা না করে যখনই সে ভূত-ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছে আর কার্য কারণের নিয়ম নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেছে তখনই তাকে মাথা হেট করে কেদে বলতে হয়েছে, ‘আমাকে বাঁচাও প্রভু, তুমি আমাদের সৃষ্টি করেছ. তুমি আমাদের পালনকর্তা, তুমি আমাদের পরম প্রিয়জন।’ আমার মনে হয় এটা কাব্য হলেও খুব ভালো কাব্য নয়। এ যেন অনন্তকে রূপ দেওয়া। এইভাবে প্রত্যেক ভাষায় অসীমকে রূপের সীমায় আনার ব্যাপার আছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই অনন্ত তো অনন্ত নন, ইনি আমাদের ইন্দ্রিয়-গোচর অনন্ত—আমাদের মাংসপেশী দিয়ে এ অনন্তকে ধরা যায়।

উপনিষদে অনন্তকে প্রকাশ করা হয়েছে নেতিবাচক ভাষায়—চাঁদ, তারা, বিদ্যুৎ, এমন কি সূর্যও তাঁকে প্রকাশ করতে পারে না।-উপনিষদের অধ্যাত্মবাদে অনন্ত এই ভাবে প্রকাশিত। বেদান্ত যেমন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দর্শন, তেমন শ্রেষ্ঠ কাব্যও।

বিশেষভাবে নজর দিলে দেখা যাবে, বেদের প্রথম এবং দ্বিতীয় অংশের মধ্যে তফাৎ হল, প্রথম ভাগের বিষয় ইন্দ্রিয়গোচর জগৎ। বাইরের জগতের অনন্ত, প্রকৃতি আর প্রকৃতির অধীশ্বর-এই নিয়ে বেদের প্রথম ধর্ম কর্ম । দ্বিতীয় ভাগে মানুষের মেধা ও-সবকে পেরিয়ে গিয়ে নতুন আলোর খোঁজ পেয়েছে। উপনিষদ বলছে-‘ভগবান মানুষের ইন্দ্রিয়গুলোকে বাইরের দিকে মুখ করে তৈরি করেছেন। বাইরের দিকে চোখ থাকলে ভেতরের সত্যের খোঁজ পাওয়া যায় না। তবে কেউ কেউ. এ রকম আছেন যাঁরা সত্যকে জানবেন বলে নিজেদের চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ভেতর দিকে। তাঁরা অন্তরের অন্তরে আত্মার গরিমা উপলব্ধি করেছেন।’

পাশ্চাত্য এই দেশ ও কালের অতীত অধ্যাত্ম জগতের খোঁজ পায় নি। তাদের মন পড়ে থাকে বাইরের প্রকৃতি এবং তার প্রভুর দিকেই। নিজের অন্তরের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যাওয়া সত্য খুজে বের কর। দেবতাদের সাহায্য ছাড়া এই সংসার স্বপ্ন থেকে মন কি জেগে উঠতে পারে ? সংসারের চাকা একবার ঘরেতে শত্রুর করলে যদি করুণাময় ঈশ্বর তার থেকে আমাদের বের করে না আনেন তবে আমাদের গতি নেই ।

তবে চরম মুক্তি দয়াময় ঈশ্বরের কাছে গেলেও হবে না। লোহার শিকলের মতো সোনার শেকলও শেকলই। দাসত্ব দাসত্বই-এর থেকে পার পাওয়ার রাস্তা কি ?

না, তুমি বন্দী নও। কোনো সময় কেউই বন্দী ছিল না। আত্মা সংসারের অতীত, আত্মাই সব। দুই কিছু নেই, তুমি সেই একই । মায়ার পর্দায় ভগবান হলেন তোমারই প্রতিরূপ। সত্যিকারের ভগবান তো আত্মাই । না জেনে মানুষ যাকে আরাধনা করে তিনি আত্মারই প্রতিরূপ। যে স্বর্গবাসী পিতাকে ভগবান বলা হয় কিসে তাঁর ভগবানত্ব ? তিনি তো তোমারই প্রতিবিম্ব, তাই তো তাঁকে দেখতে পাচ্ছ তুমি—এটা বুঝেছ কি ? তোমার বিকাশের মধ্যে দিয়েই সেই প্রতি বিম্ব ও আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

একই গাছে বসে আছে চমৎকার দুই পাখি। ওপরের পাখিটা স্থির, শান্ত, গম্ভীর। আর নিচের পাখিটা সব সময় ছটফট করছে, কখনো মিষ্টি ফল খেয়ে সখী হচ্ছে কখনো তেতো ফল খেয়ে দুঃখ পাচ্ছে। নিচের পাখিটা জীবাত্মা আর ওপরের পাখিটা পরমাত্মা। নিচের পাখিটা যখন ওপরের পাখিটাকে নিজের স্বরূপ বলে চিনতে পারে, তখন আর তার দুঃখ থাকে না।

আমিই সেই পরম সত্য। আমি বিশ্বনাথ। মোহমুক্ত

‘ঈশ্বর’ বা ‘তুমি’ নয়, বল ‘আমি’। দ্বৈতবাদের কথা হল-‘হে ভগবান তুমি আমার পিতা।’ আর অদ্বৈতবাদের কথায়, “আমার নিজের চেয়েও প্রিয় আমার আত্মা। অন্তরতম সত্যের কোনো নাম না দিয়ে তাকে সবচেয়ে কাছাকাছি কোনো নামে যদি ডাকি তবে তা ‘আমি।’

জগৎ নিছক স্বপ্ন, সত্য কেবল ঈশ্বর। আমি মুক্ত ছিলাম চিরকাল, মুক্ত থাকবও চিরকাল-এখন এটা জেনে আমি ধন্য হলাম। আমার আরাধনা তো আমারই উদ্দেশে। না প্রকৃতি, না জ্ঞানহীনতা কোনো কিছুই আমাকে বশ করে নি। আমার থেকে প্রকৃতি চলে গেছে, দেবতারা চলে গেছে যা কিছু সংস্কার পুজো পার্বণ সবই গেছে । আমি নিজেকে জানছি। আমি সেই অনন্ত। আমিই ভূমা। সুখ, দঃখ, স্ত্রী-পুরুষ, পরিচিতি জন্ম-মৃত্যু সবই লোপ পেয়েছে। আমি কাকে ভয় করব ? আমি সেই এক। নিজেকে ভয় করব নিজে? আমি ছাড়া আর কোনো সত্তা নেই। সমস্তই আমি।’

দরকার তোমার নিজের চিরমুক্ত স্বরপকে খোঁজা, কেজো মুক্তিকে খুঁজো না–সে মুক্তিকে পাবে না কখনো। তুমি তো বরাবরই মক্ত আছ।

বল— মুক্তোহহম্ । তারপরেই যদি মোহ আসে আর বলতে হয় ‘ বদ্ধ আমি’ তাহলেও পিছু হঠবে না। মায়াপাশ ছিড়ে ফেল ।

তত্ত্বটা প্রথমে শোনা দরকার । শুনে তা ক্রমাগত ভাবতে হয়। মনকে দিনরাত ওই ভাবনায় ভরিয়ে রাখ। ‘আমিই সেই পরম সত্য। আমি বিশ্বনাথ। মোহমুক্ত।’ ধ্যান করে যাও মনের সবটুকু শক্তি দিয়ে ৷ যদ্দিন না দেখতে পাবে—এই সব দেওয়াল, ঘর, চারপাশের সব কিছ গলে যাচ্ছে, দেহ থেকে শুরু করে সব কিছুই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ।

‘আমি একলা দাঁড়িয়ে থাকব, আমি সেই এক।’ চেষ্টা চালিয়ে যাও। কিসের চিন্তা ? আমরা অলৌকিক শক্তি চাই না, আমরা চাই মুক্তি । আমি ছাড়লাম গোটা পৃথিবী, তুচ্ছ করলাম সব স্বর্গ’, সব নরক। আমার মাথা ব্যথার দরকার কি অতি-প্রাকৃত শক্তি, ঐশ্বর্য আর বিভূতি নিয়ে ? মন বশে এলো কি এলো না- তা নিয়েও আমার কিছু যায় আসে না। মন ছুটতে চাইলে ছুটুক। মন চলুক নিজের মতো, আমি তো মন নই।

অদ্বৈত দর্শনের ধর্ম

সূর্যের আলো সবের ওপর যেমন পড়ে, তেমনই পড়ে অসতের ওপর । কারো চোখের দোষের জন্যে সার্যের ক্ষতি কি ? ‘সোহহম্ ।’ মন যা কিছু , করছে তা আমাকে ছুচ্ছে না। নোংরা জায়গায় সূর্যের আলো পড়লে সূর্য দূষিত হয় না। আমি সৎম্বরূপ । এটাই হল অদ্বৈত দর্শনের ধর্ম। শক্ত খুব, তবু, সাধনা করে যাও।

যা কিছ, কুসংস্কার হঠিয়ে দাও। ছেড়ে দাও গুরুশাস্ত্র বা দেবতা ! ছেড়ে এসো মন্দির, পুরোহিত, মূর্তি, অবতার এমন কি ভগৰানকেও। ভগবান বলে কেউ যদি থাকে, সে তো আমিই । সত্যকে খুঁজে বেড়ােচ্ছ যে দার্শনিকরা তারা ওঠ, অভীঃ। ভগবান আর জগত রূপ কুসংস্কারের কথা তুলো না। সত্যেরই জয় হয়। আমার অন্ত নেই।

কাল আমাতে রয়েছে, আমি কালেতে নেই

ধর্মের যা কিছু কুসংস্কার তা কেবল মিথ্যে কল্পনা। যা কিছু মিথ্যে বিশ্বাস ছাড়তে হবে। ভাৰো, তত্ত্বজ্ঞানী দর্শনবিদ হতে গেলে কি প্রয়োজন। এ হল জ্ঞানযোগ-জ্ঞানবিচারের পথ। আর সব পথ সহজ আর ঢিমেতালা—কিন্তু জ্ঞানপথে দরকার হয় প্রবল মনোবলের । এ দুর্বলের জন্যে নয়। তোমায় বলতে হবেআমি চিরমুক্ত আত্মা, আমার বন্ধন ছিল না কোনো কালে। কাল আমাতে রয়েছে, আমি কালেতে নেই। ঈশ্বরের জন্ম আমারই মনে। পরম পিতা, বিশ্বস্রষ্টা বা ভগবান তো আমারই মনেতে তৈরি। নিজেদের তোমরা যদি দর্শনবিদ মনে কর তো কাজে সেটা দেখাও। ধ্যান কর সেই পরম সত্যের। পর্যালোচনা কর তার। প্রত্যেকে প্রত্যেককে সেই পথে সহায়তা কর, আর দূর করে দাও সব -রকমের কুসংস্কার।”