Swami Vivekananda’s Words on Moral Education: তোমরা সবাই জানো আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর বিশ্বধর্ম মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে অনেক কষ্ট করে স্বামী বিবেকানন্দ এই সভায় গিয়েছিলেন। এই সভায় গিয়ে তিনি ভারতদর্শন এবং হিন্দুধর্ম সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষণ শুনে উপস্থিত সকলে একেবারে অবাক হয়ে যান। শুধু তাই নয়, তিনি সকলকে ভাই ও বোন বলে সম্বোধন করেন। আমেরিকার বড়ো বড়ো খবরের কাগজের পাতায় পাতায় ছবিসহ তাঁর ভাষণ ছাপা হয়েছিল। এরপর স্বামীজী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও অনেকগুলি শহরে নানা বিষয়ে ভাষণ দান করেন।
ওই ধর্মসভার পঞ্চম অধিবেশনের দিন অর্থাৎ ১৫ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার তিনি ভাষণের মধ্যে এই গল্পটি বলেছিলেন। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হন। তাঁরা সকলে নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। স্বামীজী বুঝতে পারলেন, এর ফলে ধর্মসম্মেলনের মূল ভাব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখানে আমরা এসেছি বিশ্বমানব ধর্মকে সকলের কাছে তুলে ধরতে। আমরা যদি বোকার মতো নিজধর্মের জয়গান গাই, তাহলে কি আমাদের আসার উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে না?
স্বামীজী বুঝতে পেরেছিলেন যে, তত্ত্বকথার মাধ্যমে এসব বক্তব্য ঠিকমতো প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই তিনি এই গল্পটি (Words on Moral Education)বলে অনেক অহঙ্কারী বক্তার মুখ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা’ শীর্ষক গ্রন্থে প্রথম খন্ডে ১১নং পৃষ্ঠায় এই গল্পটি আছে।
নীতি শিক্ষা সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী (Words on Moral Education)
মূলগল্প : অনেক বছর আগের কথা। সমুদ্রের ধারে ছিল এক কুয়ো। চারপাশে জঙ্গলে বড়ো বড়ো গাছ। দিনের বেলা সূর্যের আলো ঢুকতে ভয় পায়।
এই কুয়োর ভেতর বহু বছর ধরে বাস করছে একটা ব্যাঙ। আসলে এই কুয়োর জলেই তার জন্ম। সে কুয়ো ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারেনি। তাই তার কাছে এই কুয়োটাই হল পৃথিবী।
সেই কুয়োর মধ্যে নানা পোকামাকড় লাফিয়ে পড়ত। ব্যাঙ বাবাজী টপাটপ তাদের গিলে ফেলত। আর এর ফলে সে বেশ মোটাসোটা নাদুসনুদুস হয়ে ওঠে। খাবার সংগ্রহের জন্য তাকে মোটেই পরিশ্রম করতে হত না। অলসভাবে দিন কাটাত সে, আর ভাবত, কী মজা, আমি হলাম এই কুয়োর রাজা। কেউ এখানে এসে আমার রাজত্বে ভাগ বসাতে পারবে না। তার মনে আনন্দ হলে নাকি সুরে গান গাইত সে। এই ভাবেই দিন কেটে যায় কুয়োর ব্যাঙের।
কিছুদিন বাদে সেখানে এসে হাজির হল বিদেশী এক ব্যাঙ। তাকে দেখতে ওই কুয়োর ব্যাঙের মতো। কিন্তু তার শরীরটা অতখানি মোটা নয়, কুয়োর ব্যাঙ তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। কারণ এর আগে সে তো অন্য কোনো ব্যাঙকে দেখেনি। প্রথমে ভয়-ভয় চোখে তাকিয়ে থাকল বিদেশী ব্যাঙের দিকে। জাতভাই বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু স্বভাবগতিক কেমন, তা একবার বাজিয়ে দেখতে হবে। তারপর হঠাৎ ঐ বিদেশী-আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে সাহস করে বলল – “তুমি কোথা থেকে আসছো?” –
বিদেশী ব্যাঙ এতদিন সমুদ্রের জলে বসবাস করত। মনের আনন্দে সাঁতার কাটত সে। হঠাৎ ইচ্ছে হলে দু-চোখ মেলে দিত নীল আকাশের দিকে। তার পৃথিবীটা অনেক বড়ো। হঠাৎ জলের তোড়ে সে এই বদ্ধ কুয়োর মধ্যে এসে পড়েছে। এখানে এসে তার প্রাণ ছটফট করছে। এতটুকু জলাশয়ের মধ্যে সে থাকবে কেমন করে? মনে মনে ভাবছে, আবার কবে তার আসল জায়গা, ওই সমুদ্রে ফিরতে পারবে। তারপর এই ব্যাঙের প্রশ্ন। প্রথমটায় কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। তারপর বলল – “আমি আসছি সমুদ্দর থেকে।” বেচারী কুয়োর ব্যাঙ। এর আগে সমুদ্দরের নাম সে শোনেনি কখনও। সে অবাক হয়ে বলল –“সমুদ্দর? সে আবার কতদূর?” “
তার বুদ্ধির দৌড় দেখে সমুদ্রের ব্যাঙ একেবারে অবাক হয়ে গেল। হাসি চাপতে পারল না সে। সে বলল – “তুমি কুয়োর ভেতর থাকো, সমুদ্দর কোথায়, সে কথা তুমি বুঝবে কী করে?” –
এই কথা শুনে কুয়োর ব্যাঙ খুবই রেগে গেল। এতদিন ধরে যেখানে রাজত্ব চালাচ্ছে, টপাটপ পোকাদের গিলে খাচ্ছে, কই কেউ তো তাকে এমন বিদঘুটে প্রশ্ন করেনি! সে বলল –“সমুদ্দর কত বড়ো? আমার এই কুয়োটার মতো কি?”
সমুদ্রের ব্যাঙ এই কথা শুনে আরও একটু অবাক হল। সে একটু হেসে বলল – “তুমি ভাবতেই পারবে না সমুদ্দর কত বড়ো। কারণ তুমি তো কখনও সমুদ্দর দেখোনি।” –
মুখের হাসি মুখেই মিলিয়ে গেল তার। সে ভাবল, এভাবে ব্যাঙবাবাজীকে জব্দ করে কী লাভ? তাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে কুয়োর ব্যাঙ ভাবল, বিদেশী ব্যাঙ বোধ হয় তাকে অপমান করছে। বিজ্ঞের মতো সে বলল
-“বলো না, সত্যি, তোমার সমুদ্দর কি আমার এই কুয়োর থেকে বড়ো?”
এই কথা বলে কুয়োর ব্যাঙ কুয়োর মধ্যে লাফালাফি করতে শুরু করল। সমুদ্রের ব্যাঙ বলল – “দাদা, তুমি কুয়োর ভেতর লাফিয়ে নিজেকে কেউকেটা ভাবছো নাকি? সমুদ্দরে গেলে বুঝতে পারবে, সেটা কত বড়ো। সেখানে তুমি যতই লাফাও না, কিছুই হবে না। সমুদ্দর স্রোত তোমাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে।”
সমুদ্রের ব্যাঙের এই কথার মানে কিছুই বুঝতে পারলে না কুয়োর ব্যাঙ। বদ্ধজলাশয়ের মধ্যে তার যত বাহাদুরি। সে ভাবল, খেয়ে খেয়ে আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার শরীরটা বোধহয় মোটা হয়ে গেছে। আমি কি আর আগের মতো জোরে লাফাতে পারি? তাই বোধহয় বিদেশী ব্যাঙ আমায় দেখে ব্যঙ্গ করছে। এই বলে সে আরও জোরে লাফালাফি করতে শুরু করল।
সে জানে, এই লড়াইতে তাকে হার মানলে চলবে না। যদি একবার সে হেরে যায় তাহলে বিদঘুটে ওই ব্যাঙটা এখানে এসে জাঁকিয়ে বসবে। পোকামাকড়গুলো সে টপাটপ গিলে খাবে। আর আমাকে তার চাকর হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। না, তা কখনও হবে না।
সে বলল – “ কী, এই যে আমি এতটা লাফালাম, তোমার সমুদ্দর কি এর থেকেও বড়ো?”
এবার সমুদ্রের ব্যাঙ ভীষণ বিরক্ত হল। ঝাঁঝালো গলায় সে বলল, –“দেখো, চিরটাকাল তো তুমি এই কুয়োর মধ্যেই জীবন কাটিয়ে দিলে। এর বাইরে যে বিশাল জগৎ আছে, সেখানে কত রহস্য, কত রোমাঞ্চ, তুমি তার হিসাব রাখবে কেমন করে? কেন মিছিমিছি ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে লাফঝাঁপ করে আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছো। যেমন আছো, তেমন থাকো। বেশি বাড়াবাড়ি করতে যেও না।”
এসব কথা শুনে কুয়োর ব্যাঙ তো রেগে কাঁই। সে কটমট করে তাকাল সমুদ্রের ব্যাঙের চোখের দিকে। তারপর চিৎকার করে বলল – “তুমি কি আমাকে বোকা পেয়েছো নাকি? আমি লাফঝাঁপ দেখাচ্ছি কেন? শরীরটাকে তরতাজা রাখব বলে। যতই তুমি সমুদ্দর-সমুদ্দর করে চেঁচাও না কেন, তোমার কথা আমি কিছুই বিশ্বাস করব না। আমি জানি এই কুয়োর থেকে বড়ো জায়গা পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আর থাকলেই বা আমার কী? আমি তো এখানে দিব্যি আরামে আছি। খাবার সংগ্রহের জন্য আমাকে মোটেই পরিশ্রম করতে হয়না। জলের তোড়ে কত পোকামাকড় ভেসে আসে। আমি কপাত্ করে তাদের খেয়ে নিই।
সমুদ্রের ব্যাঙ এবার শান্তভাবে বলল –“তুমি কিন্তু মিছিমিছি আমার ওপর রাগ করছো। সত্যি, সমুদ্দর যে কত বড়ো, কী তার উচ্ছ্বাস, কী বিচিত্র তার রূপ, সে কি তুমি ধারণা করতে পারবে? তুমি তো জীবনে সমুদ্দর কোনদিন চোখে দেখোনি। দেখবে, এমন আশা নেই। তাই তোমাকে কুয়োর মধ্যেই জীবন কাটাতে হবে।”
এমন কথা আর কতক্ষণ সহ্য করবে কুয়োর ব্যাঙ। গর্-গর্ শব্দ করতে লাগল সে। রাগে তার গলা ফুলে গেল। সে আরও জোরে চিৎকার করে বলল -“বোকা, মিথ্যুক কোথাকার, ভেবেছো বড়ো বড়ো কথা বলে আমাকে ভয় পাইয়ে দেবে? তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করব যে, তোমার সমুদ্দর আমার এই কুয়োর থেকে বড়ো না? ভণ্ড কোথাকার! এখুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও।
এই কথা বলে সে সমস্ত শক্তি সংগ্রহ করে তার পায়ের ক্ষুদে আঙুল তুলে নাচতে লাগল । সে জানে, ওই আপোদটাকে চোখের সামনে থেকে দূর করতে হবে, না হলে এখানে টিকে থাকা মুশকিল ।
গল্পের মূল ভাব (Words on Moral Education):
আমরা কখনও অহঙ্কারের বশীভূত হব না। যার মন ছোটো, তার মনেই অহঙ্কার জন্মায়। যে সত্যিকারের বড়ো মানুষ, সে সবসময় বিনয় প্রকাশ করে থাকে। অপরের বিশ্বাসের প্রতি মর্যাদা থাকা দরকার। এই পৃথিবীতে নানাভাব নিয়ে নানা মানুষের আবির্ভাব ঘটে। সকলকেই তো আর এক পথের পথিক করা যায় না। আমরা কখনও অন্যের ধর্মমতে আঘাত করব না। আমরা কখনও এমন কাজ করব না, যাতে মনুষ্যত্ব আঘাত পায়। প্রত্যেক
ধর্মের মধ্যে কিছু কিছু সৎ কথা আছে। কোনো ধর্ম হিংসার কথা বলে না। সব ধর্মের মূল ভাব হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। অথচ আমরা বোকার মতো কলহবিবাদ করে থাকি। নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য ছেলেমানুষি করি। এটি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। না হলে বিশ্বমানবধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে কেমন করে।
গল্পকথক বিবেকানন্দের নিজের জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে যা শুনলে সত্যি সত্যি গল্প বলে মনে হয়। আসলে তিনি একটির পর একটি বাধা এবং প্রতিবন্ধকতা জয় করে শেষ অবধি সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পা রেখেছিলেন। তাই আমাদের বার বার উচিত তাঁর জীবন-কাহিনী পড়া এবং তা থেকে উদ্বুদ্ধ হওয়া।
[আরো পড়ুন: Swami Vivekananda on concentration: বিবেকানন্দ ও আত্মনির্ভরতা]