ভারতীয়দের গণিতে অবদান, Contribution of Indians in Mathematics

Contribution of Indians in Mathematics
Contribution of Indians in Mathematics

ভারতীয়দের গণিতে অবদান (Contribution of Indians in Mathematics): হিন্দু সভ্যতা গাণিতিক জ্ঞানের প্রসারে উচ্চ পর্যায়ে আরোহণ করলেও পথটি অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় তা পরবর্তীকালে অনুসরণ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। গ্রিক গাণিতিকদের মন প্রধানত জ্যামিতিক ছিল, সেখানে হিন্দু গাণিতিকদের মন ছিল আঙ্কিক। সংখ্যাসূচক প্রতীক, সংখ্যা বিজ্ঞান ও বীজগণিতে ভারত পূর্বের গ্রিস অপেক্ষা অনেক বেশি উচ্চতায় উঠেছিল। আদ্যিকাল থেকে ভারতীয়দের গণিতে খুব উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। নাম্বার সিস্টেম, শূন্যের ধারণা ইত্যাদিতে ভারতীয়রা গণিত জগতে উল্লেখযোগ্য উপহার দিয়েছিলেন।

Whatsapp গ্রুপে যুক্ত হন
Telegram গ্রুপে যুক্ত হন

আর্যভট্ট, ভাস্কর এবং শ্রীধর আচার্য-র মতো ভারতীয় গণিতবিদ (Pie)-এর মানের ধারণা, ফাংশন (Function). দ্বিঘাত সমীকরণ এবং তার সমাধান সম্পর্কে অনেক
গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে, রামানুজন এবং পি এল ভাটনগর-এর মতো গণিতবিদ গণিত ইতিহাসের বড়ো বড়ো উজ্জ্বল তারকা। মহাবীর ‘গণিত সার সংগ্রহ’ (Ganit Sara Sangraha) লিখেছিলেন। তিনি দুটি সংখ্যার লসাগু নির্ণরের পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। ব্রহ্মগুপ্ত বৃত্তস্থ চতুর্ভুজের ক্ষেত্রফলের মান নির্ণয়ের সূত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন।

শ্রীধর আচার্য গণিতের তিনটি মূল্যবান গ্রন্থ লিখেছিলেন—ত্রিশতিকা (Trisatika), পাটিগণিত (Patiganit) এবং বীজগণিত (Bijganita)। তিনি দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধানের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন ও বীজগাণিতিক সূত্রের জ্যামিতিক ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন।

শ্রীপতিও গণিত শাস্ত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লেখেন সিদ্ধান্ত-শেখর (Siddhanta Shekhar) এবং গণিত-তিলক (Ganit-Tilak)।

গণিতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানার জন্য আগ্রহীরা এখানে ক্লিক করুন

ভাস্কর-এর গণিতে অবদান অপরিসীম। তাঁর গণিত বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি হল ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’। এই বইয়ের একটি খণ্ডের নাম লীলাবতী। লীলাবতী খণ্ডটি নিয়ে একাধিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। লীলাবতী ও বীজগণিত হচ্ছে গণিতের বই। লীলাবতী সম্ভবত ভাস্করের কন্যা ছিলেন। ধারণা করা হয় খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়ে তিনি বাবার ঘরে চলে আসেন। ভাস্কর তাকে ধীরে ধীরে পাটিগণিত শেখান। তখনই তিনি বইটি লেখেন। মেয়ের নামে নাম দেন। আর-এক মতে, ভাস্করের কোনো মেয়ে ছিল না । তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল লীলাবতী। তাঁর স্মরণে তিনি বইটির নাম দেন।

Contribution of Indians in Mathematics

প্রাচীন সময়কাল (Ancient Period) (3000 BC-500 BC):

প্রাচীন সময়কালকে আমরা তিনটি প্রধান সময়সীমায় বিভক্ত করতে পারি-

বৈদিক সময়কাল (3000 BC-1500 BC):

এই সময়ের মধ্যে সংখ্যা সিস্টেম এবং দশমিক পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। এই সময়কালে বিভিন্ন ব্যাখ্যা বেদ থেকে প্রাপ্ত হয় এবং সংহিতা আকারে প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধানের জন্য সূত্র আবিষ্কৃত হয়।

সুলভ সময়কাল (1500 BC-1000 BC):

জ্যামিতিতে জ্ঞানের প্রসার এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

বেদান্ত সময়কাল ( 1000 BC-500 BC):

এই সময়কাল জ্যোতির্বিদ্যার জন্য বিখ্যাত। সেই সময় গ্রহ ও মহাকাশবিজ্ঞান, গণিতের একটি শাখা হিসাবে পরিচিত ছিল।

প্রারম্ভিক সময়কাল (Early Period) (500 BC-500 AD):

ওই সময়কালে শুধুমাত্র ‘বখশালী গণিত’ (Bakhshali Ganit) গ্রন্থে ওই সময়কালের গণিতচর্চা সম্পর্কে কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়—সংখ্যা লেখার ক্ষেত্রে

  • প্লেস মানের (Place value) ব্যবহার
  • শূন্যের আবিষ্কার
  • বীজগণিতের সূচনা
  • পাটিগণিতের উন্নয়ন
  • জ্যোতির্বিদ্যার উন্নয়ন

ষষ্ঠ শতাব্দীতে, বরাহমিহির তাঁর গ্রন্থ ‘পঞ্চ সিদ্ধান্তিকা’ (Pancha Siddhantika)-তে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন।

মধ্যযুগীয় সময়কাল (Medieval Period) (500 AD-1200 AD)

এই সময়কাল আর্যভট্ট থেকে শুরু হয় এবং ভাস্কর দ্বিতীয় পর্যন্ত চলতে থাকে। আর্যভট্টকে বীজগণিতের অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি চতুর্থ দশমিক পর্যন্ত 𝝅 এর সঠিক মান (62832/20,000) দিয়েছিলেন।

পরবর্তী-মধ্যযুগীয় সময়কাল (Post-Medieval Period) (1200 AD-1800 AD)

উত্তর ভারতে বিদেশি আক্রমণের ফলে, এই সময়ের খুব সামান্যই গণিতের চর্চা হয়েছিল। ওই সময়ে দক্ষিণ ভারত, বিজ্ঞান এবং গণিত শেখার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই সময়কালে কমলাকর (Kamlakar) 1600 খ্রিস্টাব্দে ‘সিদ্ধান্ত-তত্ত্ব'(SiddhantaTarva) লিখেছিলেন। বিবেক নারাইন (Vivek Narain) লিখেছিলেন গণিত-কৌমুদী (Ganit-Kaumudy) এবং 1587 খ্রিস্টাব্দে নীলকণ্ঠ (Neel Kantha) তাজিক নীলকণ্ঠ (Tajik Neel Kantha) লিখেছিলেন। পণ্ডিত জগন্নাথ (1731 খ্রিস্টাব্দে) টলেমি এবং ইউক্লিডের কাজ সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করেন। এই বই “সম্রাট সিদ্ধান্ত’ (SamratSiddhanta) হিসাবে পরিচিত হয়।

বেদাঙ্গ সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত সুখ গ্রন্থগুলিকে সঠিকভাবে গ্রন্থ বলা চলে না কারন গণিত চর্চা এই গ্রন্থগুলির মুখ্য বিষয় ছিল না। তবে এই গ্রন্থগুলি জ্যামিতি ও বীজগণিতের জ্ঞানে পরিপূর্ণ ছিল। অতএব এই গ্রন্থগুলি পরোক্ষ গণিতশ্রদ্ধ হলেও গণিত ঐতিহাসিকদের কাছে ওইগুলির সমধিক মূল্য আছে। প্রাপ্ত সুল্ব গ্রন্থগুলির মধ্যে বৌধায়ন সুল্ব’ সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম। কাত্যায়নের সুল্বটিতে জ্যামিতির তত্ত্ব ও তথ্য অধিকতর সুবিন্যস্ত। গণিতের পাশাপাশি প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা করা হত। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে হিন্দুদের প্রাচীনতম গ্রন্থ হল ‘বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ’। প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গর্গ। ঋষিপুত্র, কপিলাচার্য, কশ্যপ, দেবল প্রমুখ আরও কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞদের পরিচয় পাওয়া যায়।

বেদোত্তর যুগে গণিতশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখাগুলির মধ্যে জ্যোতিষ শাখাই ভারতীয়দের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ লাভ করে। এই যুগে গণিতবিদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আর্যভট্ট। আর্যভট্টের জ্যোতিষীয় মতবাদ ও পদ্ধতি সমসাময়িক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাঁর শিষ্য ও অনুগামীদের মধ্যে কয়েকজন হলেন—লাটদেব, ভাস্কর, লল্ল প্রমুখ। এদের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেন। লাটদেব। ইনি রোমক, পৌলিশ ও সূর্য সিদ্ধান্তগুলি ব্যাখ্যা করেছিলেন। প্রাচীন ভারতীয় সমাজ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘সর্বসিদ্ধান্তগুরু’। আর্যভট্টের পর ব্রহ্মগুপ্ত ছিলেন সেই যুগের আর একজন মহান গণিতবিদ। ব্রহ্মগুপ্ত, বিখ্যাত ঐতিহাসিক Sarton-এর ভাষায় ছিলেন, “One of the greatest scientists of his race and the greatest of his time.” তিনি 628 খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন ‘ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত’। জ্যোতিষ শাস্ত্রেও তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।

পরবর্তী সমস্ত গণিতবিদরা ব্রহ্মগুপ্তের পদ্ধতি ও গণনার ফল ব্যবহার করতেন। ব্রহ্মগুপ্তের পর ভারতীয় গণিতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন ভাস্করাচার্য। তাঁর গাণিতিক জ্ঞান ও বিস্ময়কর গণিত প্রতিভার জন্য তিনি এখনও আমাদের মননে স্থান অধিকার করে রয়ে গিয়েছেন। পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় ৪তম থেকে 10তম শতকে কয়েকজন বিখ্যাত বীজগণিতন্ত্রের জন্ম হয়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গণিতজ্ঞ হলেন শ্রীধর, পদ্মনাভ ও মহাবীর। শ্রীধরের রচিত “ত্রিশতিকা বীজগণিতের একটি মূল্যবান গ্রন্থ। কিন্তু ভাস্করাচার্যের পর থেকেই ভারতীয় গণিতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অবসান ঘটেছিল। একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিকের উক্তির প্রতিধ্বনি করে বলা যায় যে, “ভাস্করের প্রতিভা মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো প্রদীপ্ত হলেও তাঁর আবির্ভাব কালকে ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যাহ্ন বলা যায় না।” তাঁর আগের থেকেই এদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবনতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। দীপ নেবার আগে যেমন শিখা শেষবারের মতো অস্বাভাবিক দ্যুতিতে জ্বলে ওঠে, বেদোত্তর ভারতে ভাস্করের আবির্ভাব অনেকটা সেই রকম ব্যাপারকেই ইঙ্গিত করে।