প্রাচীন সনাতন শিক্ষাদান পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে গণিত শিক্ষায় এখন গুরুত্ব পাচ্ছে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক প্রক্রিয়া। এই নিবন্ধে গণিত শেখার বিভিন্ন পদ্ধতি, বিশেষত পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি (Observation Method) ও তার ধাপগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কীভাবে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে যুক্তিনিষ্ঠ মনোভাব ও গভীর ধারণা গঠনে সাহায্য করে, এবং এই learning methods of mathematics কেন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য, তা এই আর্টিকেলে তুলে ধরা হয়েছে। এটি গণিত শিক্ষণের কৌশল এবং ব্যবহারিক দিকগুলি সম্পর্কে একটি নির্ভরযোগ্য নির্দেশিকা।

গণিত শিখন পদ্ধতি (Learning Methods of Mathematics)
সনাতন থেকে আধুনিক শিক্ষণ প্রক্রিয়া
আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে যে শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রচলিত, সেখানে শিক্ষকের ভূমিকাই ছিল মুখ্য এবং শিক্ষার্থীর ভূমিকা ছিল অপেক্ষাকৃত গৌণ। এই কারণে প্রাচীন শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে ‘সনাতন শিক্ষাদান’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। শিক্ষাদান কার্যক্রমকে সফলভাবে পরিচালনা করতে উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষ ও অনুকূল পরিবেশ অপরিহার্য। বর্তমানে, শিখনকে আরও প্রয়োগমুখী করে তোলার জন্য শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলিকে সঠিকভাবে প্রকাশ এবং পাঠক্রমকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে শিক্ষণ পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। শিক্ষণ এক প্রকার কলা। শিক্ষার্থীদের সামনে কোনো বিষয়বস্তুকে কীভাবে কার্যকরভাবে উপস্থাপন করা হবে, তা শিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। শিক্ষাদানের সাফল্য অনেকাংশেই সঠিক শিক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল।
Brondy-এর মতে,
“Methods refer to the formal structure of the sequence of acts commonly denoted by instruction.”
অর্থাৎ, সঠিক নির্দেশানুসারে প্রথাগত কাঠামোর ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে কোনো কিছু সম্পাদন করাকেই পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে।
‘Method’ বা পদ্ধতি শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Modus’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘Mode’ বা ‘Way’ (ধারা বা পথ)। যে প্রক্রিয়ার দ্বারা শিক্ষক মহাশয় বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানকে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করেন, তাকেই শিক্ষণ পদ্ধতি বলা হয়। শিক্ষণ পদ্ধতি হল কোনো বিষয়কে উপস্থাপনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও বিজ্ঞানসম্মত পথ।

গণিত শিক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি
গণিত বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য নানা প্রকার পদ্ধতি রয়েছে। তবে এদের মধ্যে কোনো একটি পদ্ধতিই স্বয়ংস্পূর্ণ নয়। বিভিন্ন গাণিতিক বিষয় আলোচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় লক্ষ করা যায় যে, গণিতের কোনো একটি বিষয় পাঠদানকালে শিক্ষক মহাশয় এক বা একাধিক শিক্ষণ পদ্ধতির সংমিশ্রণে পাঠদান সম্পন্ন করে থাকেন।
গণিত শিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো:
১. পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি (Observation Method)
সাধারণভাবে পর্যবেক্ষণ বলতে কোনো ঘটনা বা বিষয়কে মনোযোগ সহকারে অবলোকন বা নিরীক্ষণ করে সেই সম্পর্কে একটি ধারণা গ্রহণ করাকে বোঝায়। অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণ হল একটি সুশৃঙ্খলবদ্ধ, পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া।
পি.ভি. ইয়ং (PV Young)-এর মতে,
“Observation may be defined as systematic viewing, coupled with consideration.”
অর্থাৎ, দৃশ্যমান কোনো ঘটনা বা বিষয়কে সুশৃঙ্খলভাবে অবলোকন করাই হল পর্যবেক্ষণ।
সহজ ভাষায়, পর্যবেক্ষণ হল কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে সংঘটিত ঘটনাবলির সঠিক উপায়ে ধারণা গ্রহণ। যে পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো শিক্ষার্থী কোনো পাঠ্য বিষয়কে প্রত্যক্ষভাবে অনুধাবনের মাধ্যমে সেই সম্পর্কে সঠিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা লাভ করে, তাকে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি বলা হয়।
গণিত সংক্রান্ত আরেকটি পেডাগোজি পোস্ট এর জন্য নিচে ক্লিক করুন
👇👇👇👇👇
বিদ্যালয় পাঠক্রমে গণিতের স্থান: Place of Mathematics in School Curriculum
Moser & Kalton-এর মতে,
“Observation Method is an accurate watching and noting of phenomena or subject as they occur in a nature with regard to cause and effect relations.”
অর্থাৎ, পারস্পরিক কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রকৃতিতে সংঘটিত যেকোনো ঘটনাবলি বা বিষয়বস্তু সম্পর্কে সঠিকভাবে ধারণা গ্রহণই হল পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি।
পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির ধাপসমূহ
এই শিক্ষণ পদ্ধতিটি কতকগুলি নির্দিষ্ট ধাপের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে:
(ক) বিষয়বস্তুর নির্বাচন (Selection of Content):
প্রথমেই স্থির করা হয়, কোন বিষয়টি এই শিখন পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপিত করা হবে।
(খ) সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য স্থিরীকরণ (Fixation of definite aims):
এই পদ্ধতিতে পাঠ্য বিষয়টিকে উপস্থাপিত করলে শিক্ষার্থীরা কী ধরনের আচরণগত শিখন সামর্থ্য অর্জন করবে, তা সুস্পষ্টভাবে স্থির করা হয়।
(গ) পরিকল্পনা (Planning):
যথাযথ পরিকল্পনা অনুসরণ করে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি পরিচালিত হয়। এখানে প্রয়োজনীয় শিখন-শিক্ষণ উপকরণ নির্বাচন, শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপনার কৌশল এবং সময় বন্টন সম্পর্কে শিক্ষককে পূর্বেই একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়।
(ঘ) তথ্য সংগ্রহ (Collection of Data):
এই স্তরে, পূর্ব পরিকল্পনা মতো শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগের মাধ্যমে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ওই বিষয় সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে থাকে।
(ঙ) ধারণা গঠন (Concept Formation):
শিক্ষকের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীরা সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ওই বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ও সঠিক ধারণা গঠন করে এবং বিষয়টিকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।
উদাহরণের মাধ্যমে প্রয়োগ
উদাহরণ ১: যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ সমন্বিত বিশেষ ধর্ম
| ধাপ | প্রক্রিয়া | প্রয়োগ |
| উদ্দেশ্য স্থিরীকরণ | শিক্ষার্থীরা শিখবে | যোগ ও গুণ বিনিময় ও সংযোগ নিয়ম মেনে চলে, কিন্তু বিয়োগ ও ভাগ তা মেনে চলে না। |
| পরিকল্পনা | শিক্ষক যা করবেন | প্রয়োজনীয় চার্ট তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে প্রদর্শন। প্রতিটি প্রক্রিয়ার পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা এবং প্রাপ্ত ফলের তুলনা করতে বলা। |
| তথ্য সংগ্রহ | শিক্ষার্থীরা যা করবে | শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় প্রশ্নাবলীর উত্তর (যেমন: বিনিময় নিয়ম কী? কোন প্রক্রিয়াগুলি সংযোগ নিয়ম মেনে চলে?) সংগ্রহ ও সংরক্ষণ। |
| ধারণা গঠন | প্রাপ্ত ফলাফল | যোগ ও গুণ বিনিময় ও সংযোগ নিয়ম মেনে চলে এবং বিয়োগ ও ভাগ এই নিয়মগুলি মেনে চলে না – এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভ। |
উদাহরণ ২: সাত ও আট অঙ্কের ধারণা
| ধাপ | প্রক্রিয়া | প্রয়োগ |
| উদ্দেশ্য স্থিরীকরণ | শিক্ষার্থীরা শিখবে | সাত ও আট অঙ্কের সংখ্যাকে কথায় প্রকাশ করা, উদাহরণ দেওয়া এবং সমস্যা সমাধান করা। |
| পরিকল্পনা | শিক্ষক যা করবেন | সাত ও আট অঙ্কের সংখ্যা সমন্বিত চার্ট প্রদর্শন। সংখ্যার গঠনগত বৈশিষ্ট্য ও কথায় প্রকাশের পদ্ধতি বিশেষভাবে লক্ষ করতে বলা। |
| তথ্য সংগ্রহ | শিক্ষার্থীরা যা করবে | সাত ও আট অঙ্কের সংখ্যা কীভাবে প্রকাশ করতে হয়, উদাহরণ দেওয়া, এবং বিভিন্ন সংখ্যার বিয়োগফল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। |
| ধারণা গঠন | প্রাপ্ত ফলাফল | কোনো সংখ্যা শূন্য দিয়ে শুরু হবে না; সাত অঙ্কের সংখ্যা ‘লক্ষ’ দিয়ে ও আট অঙ্কের সংখ্যা ‘কোটি’ দিয়ে শুরু হয়; সাত অঙ্ক থেকে আট অঙ্কের সংখ্যা বিয়োগ করলে ঋণাত্মক সংখ্যা পাওয়া যায় – এই বিষয়ে ধারণা লাভ। |

পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সুবিধা (Advantages of Observation Method)
- গভীর ধারণা: এই পদ্ধতিতে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করা যায়।
- উদ্দেশ্য যাচাই: বিষয়গত উদ্দেশ্যগুলিকে সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়।
- বিমূর্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ: শিক্ষার্থীদের বিমূর্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
- নির্ভরযোগ্যতা: এটি খুবই নির্ভরযোগ্য একটি শিখন পদ্ধতি।
- পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বৃদ্ধি: শিক্ষার্থীদের মধ্যে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও যুক্তিশীল মনোভাব গঠনে সাহায্য করে।
- জ্ঞানের সুসংহতকরণ: শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্ন জ্ঞানকে সুসংহত করতে সাহায্য করে।
- মূর্ত উপস্থাপন: শিখনকে মূর্ত করে উপস্থাপিত করতে পারে এবং পাঠ্যবিষয় সম্পর্কে সুশৃঙ্খল ধারণা গঠনে সক্ষম।
পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির অসুবিধা (Disadvantages of Observation Method)
- শ্রম ও সময়সাপেক্ষ: এটি একটি শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি।
- হাতেকলমে কাজের সুযোগ কম: শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে কাজ করার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম থাকে।
- অভিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়োজন: এই পদ্ধতি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রয়োজন হয়।
- বিঘ্নিত শিখন: সঠিকভাবে শ্রেণিকক্ষ পরিচালিত না করতে পারলে শিখন প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।
- নির্দেশনার অভাব: সঠিক নির্দেশনার অভাবে অনেক সময় এই পদ্ধতি কার্যকর হয় না।