আজকের প্রতিবেদনে আমরা গাছ আমাদের বন্ধু রচনা (Trees are our Friends Essay) সম্পর্কে আলোচনা করব। সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে মানুষের সাথে গাছের চির বন্ধুত্ব সম্পর্ক।
গাছ তার সবকিছু উজাড় করে দেয় প্রকৃতির উপকারে। আজ আমাদের সেই পরম আত্মীয় গাছ সম্পর্কে গাছ আমাদের বন্ধু রচনা সম্পর্কে আলোচনা করতে চলেছি।
Trees are our Friends Essay
“অন্ধভূমি গর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ”
ধরিত্রীর বক্ষে প্রথম প্রাণের অস্তিত্ব:
ধরিত্রীর বক্ষে প্রথম প্রাণের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বৃক্ষ। ভূমিগর্ভের অন্ধকার বিদীর্ণ করে বৃক্ষই প্রথম প্রণাম জানিয়েছিল প্রভাত সূর্যকে। ধরিত্রীর বন্ধ্যাদশা ঘুচিয়ে ধীরে ধীরে তার বৃক্ষকে সবুজায়িত করেছে বৃক্ষ। রবীন্দ্রনাথ বৃক্ষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “মৃত্তিকার বীর সন্তান।” সৃষ্টির আদিলগ্নে যে উৎসব বনে বনে সকালে-সন্ধ্যায়, গ্রীষ্মে-বর্ষায়, শীতে-বসন্তে উদ্যাপিত হত, তাতে মানুষের তেমন ভূমিকা ছিল না।
বৃক্ষই প্রথম আশ্রয় :
এরপর যেদিন ধরিত্রীতে মানুষের আবির্ভাব হল, সেদিন বৃক্ষই ছিল মানুষের প্রধান আশ্রয়। আদিম মানুষকে বৃক্ষই দিয়েছে খাদ্য, পরিধেয় আর নিরাপদ আশ্রয়। সভ্যতার অগ্রগতিতেও বৃক্ষ আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি, বরং তার প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের জীবনচক্র আজও আবর্তিত হচ্ছে বৃক্ষকে আশ্রয় করেই।
প্রাচীন সভ্যতার উন্মেষ :
ভারতবর্ষে তপোবনের মধ্যে একদিন সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল। এখানেই ভারতের ঋষিগণ বৃক্ষের বাণী শুনতে পেয়েছিলেন। এই তপোবনেই ছিল তাঁদের বিহার, তপোবনের ফলমূল ছিল তাঁদের খাদ্য, তপোবনের পশু-পক্ষী,বৃক্ষলতার সঙ্গে ছিল তাঁদের সুনিবিড় সম্পর্ক। এখানেই প্রথম আর্য ঋষিরা সামগান করেছিলেন। এখানেই রচিত হয়েছিল, ‘বেদ-উপনিষদ’। তপোবনেই প্রথম মানুষের কাব্যকাহিনি রচিত হয়েছিল। তাই দেখা যায় রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্যে অরণ্যের প্রভাব এত বেশি। রামচন্দ্রের চোদ্দো বছর বনবাস মহাভারতের বনপর্ব সবই অরণ্যের সঙ্গে নিবিড় যোগ ঘোষিত হয়েছে।
শহুরে সভ্যতার নিমর্মতা:
অতীতের সে আরণ্যক-জীবন আর নেই। এসেছে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। বনভূমির অভাবে বৃষ্টিপাত কমেছে, বেড়েছে মরুভূমি। যার জন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “দাও ফিরে সে অরণ্য / লহো হে নগর।”
নিত্য ব্যবহার্য :
বৃক্ষ মানুষের পরম উপকারী বন্ধু। বৃক্ষ থেকে পশুর খাদ্য, মানুষের খাদ্য, ননা রোগ নিরাময়ের ওষুধপত্র পাওয়া যায়। রং, তেল, চিনি—এসব হল বৃক্ষের দান। সভ্য মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হল কাগজ। বৃক্ষ থেকেই এই কাগজ তৈরি হয়।
স্থলযান, নৌযান, গৃহনির্মাণ, গৃহসজ্জার আসবাব নির্মাণে বৃক্ষের অবদান সর্বাধিক। এ ছাড়া আরও অজস্র নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য আমরা বৃক্ষের অকৃপণ দানে পেয়ে থাকি।
বনবৃদ্ধি : মানুষের বাঁচার আশ্রয়
সবুজ রং মানুষের দৃষ্টিকে করে নন্দিত। শ্যামল প্রকৃতির সংস্পর্শে এলে মানুষের মন সতেজ হয়। সুন্দরবন অঞ্চলে যথেচ্ছ বৃক্ষচ্ছেদন হওয়ায় বৃষ্টির পরিমাণ কমে গেছে। উৎপাদনের স্বার্থে বৃষ্টির প্রয়োজন। পর্যাপ্ত বৃষ্টির জন্য বনবৃদ্ধির প্রয়োজন। আরও বনবৃদ্ধি হলেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষিত হয়। মানুষ বাঁচে।
বনমহোৎসব :
রবীন্দ্রনাথ বনবৃদ্ধির মানসে শান্তিনিকেতনে শ্রাবণমাসে ‘বনমহোৎসব’-এর আয়োজন করেছিলেন। এই উৎসবের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা লিখেছেন—
‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে/হে প্রবল প্রাণ।……… মাধুরী ভরিবে ফুলে ফলে পল্লবে/ হে মোহন প্রাণ’ –
অর্থাৎ, মরুবিজয় করতে এবং ফুলে-ফলে পল্লবে মাধুরী ভরে তুলতেই বনমহোৎসবের সূচনা। রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত এই উৎসবের ধারা শান্তিনিকেতনে আজও অব্যাহত আছে। সরকারও এই উৎসবকে গ্রহণ করেছেন। শান্তিনিকেতনের বালক আশ্রমিকেরা—ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পঞ্চভূতের রূপসজ্জায় সেজে এসে বৃক্ষবন্দনা করে, তারপর বৃক্ষরোপণ করে।
বৃক্ষচ্ছেদন নয়, বৃক্ষরোপণ করা উচিত :
বনমহোৎসবে বৃক্ষরোপণই শেষ কথা নয়। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে মাতা তাকে পরম যত্নে লালনপালন করে বড়ো করে তোলেন। তেমনি শিশু বৃক্ষকেও সযত্ন পালনে বড়ো করে তোলা প্রয়োজন। সরকারি, বেসরকারি স্কুল, কলেজ, সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে বনমহোৎসব প্রতি বছর প্রতিপালিত হয়। পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, সাড়ম্বরে বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের পর রোপিত বৃক্ষ যাতে বিনষ্ট না হয়, সেদিকে কারও লক্ষ থাকে না। আজকের দিনের স্লোগান হওয়া উচিত ‘গাছ লাগাও, প্রাণ বাঁচাও’। বৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য সকলের কণ্ঠে ধ্বনিত হওয়া উচিত বৃক্ষচ্ছেদন নয়, বৃক্ষরোপণ।
উপসংহার-Trees are our Friends Essay
শহুরে জীবনের দূষিত পরিবেশ আজ ভীষণভাবে মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আরণ্যক সভ্যতার শান্ত জীবনের কথা। কিন্তু এই যান্ত্রিক জীবন বর্জন করে আবার অরণ্যে ফিরে যাওয়া মানুষের পক্ষে আজ এখন সম্ভব নয়। যদিও একটু চেষ্টা করলেই অরণ্যের ছায়া এনে মানুষের জীবনকে পরিপূর্ণ করা সম্ভব।
আমরা যদি আমাদের আশেপাশে শহরের উপকণ্ঠে অলিতে গলিতে যেখানে জায়গা ফাঁকা আছে সেখানেই বৃক্ষরোপণ করি তাহলেই আমাদের পরম বন্ধু গাছ আবার আমাদের প্রাণ বায়ুকে শোধন করে দেবে। বিষাক্ত জীবাণুকে নষ্ট করে দেবে। শৈশব থেকে যেমন একটি শিশু ক্রমে বড় হয় তেমনি একটি গাছ চারা থেকে বৃক্ষের রূপান্তরিত হয়ে প্রকৃতির নিজ গুনে প্রাণী জগতের অস্তিত্ব রক্ষা করবে।