Success story of Swami Vivekananda: স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে ১৮৯৪ সালে তাঁর প্রিয় শিষ্য আলাসিঙ্গাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠির শুরুতে তিনি একটি গল্পের অবতারণা করেছিলেন। গল্পটি খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। এই গল্পের মাধ্যমে স্বামীজী বলতে চেয়েছেন যে, পথই পথ করে দেয়। নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে সাফল্য আসবে না। পথের প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে আমরা যদি মনের জানলা-দরজা বন্ধ করে বদ্ধ ঘরে বসে থাকি, তাহলে ভাগ্য কি আমাদের সাহায্য করবে? পথে নামলে পথই সাফল্যের রাস্তা দেখিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত এক পা এক পা করে আমরা ঈপ্সিত সাফল্যের লক্ষ্যপথে পৌঁছোতে পারব।
স্বামীজী বিভিন্ন সময় তাঁর প্রিয় শিষ্য-শিষ্যাদের অসংখ্য চিঠি লিখেছিলেন। কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নিয়মিত সময় করে চিঠি লিখতেন ও নানা চিঠির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কিছু রূপক গল্পের অবতারণা করেছেন। স্বামীজী জানতেন এইভাবে ছোটো গল্পের মাধ্যমে আমরা আমাদের চরিত্রের মৌলিক পরিবর্তন করতে পারি।
উদ্বোধন থেকে প্রকাশিত ‘স্বামীজীর বাণী এবং রচনা’ গ্রন্থের সপ্তম খন্ডে ৬৪ নং পৃষ্ঠায় এই গল্পটির উল্লেখ আছে।
Success story of Swami Vivekananda
মূল গল্প -পথ যে আমাকে ডাকে:
এক যুবক আনমনে হেঁটে চলেছে গাঁয়ের আলপথ দিয়ে। তখন চারপাশের সোনালী ধানের বন্যা। ভারি সুন্দর, প্রাকৃতিক পরিবেশ। চাষীরা সারা বছর ধরে ঘাম ঝরিয়ে যে পরিশ্রম করে। এখন সেই পরিশ্রমের ফসল এসেছে। মুখে তাদের বসন্তের গান। গান গাইতে গাইতে তারা ধান কাটছে। তারা জানে, এই ধান তাদের সারা বছরের অহঙ্কার। ওই দূরে দেখা যাচ্ছে বাংলার গ্রাম। মনে হচ্ছে প্রকৃতিদেবী বুঝি নিজের হাতে তার প্রিয়তমা কন্যাটিকে সাজিয়ে দিয়েছে। চারপাশে আম, জাম, কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট – কত গাছের সমারোহ। সত্যি, গ্রামবাংলায় এলে চোখ বুঝি জুড়িয়ে যায়। মন শান্ত হয়ে ওঠে। মনে হয় আমরা বারবার যেন গ্রামবাংলায় ফিরে আসতে পারি। সত্যি, তাই বোধহয় কবিরা বারবার নানাভাবে প্রকৃতির বন্দনা করেছেন। গল্পলেখকেরা কত গল্প লিখেছেন।
শুধু প্রকৃতি নয়, এখানকার মানুষজন বড্ড ভালো। তারা সহজ সরল। লোভ থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যা রোজগার করে, তাই দিয়ে জীবন কাটায়। তাদের মনে খুব বেশি আকাঙ্খা নেই। তারা জানে সহজ সুন্দরভাবে জীবন কাটানোর মধ্যে একটা আলাদা ছন্দ আছে।
দু’চোখ ভরে প্রকৃতির অনন্য শোভা দেখতে দেখতে হনহন করে এগিয়ে চলেছে ওই যুবক। সে যাবে গোবিন্দপুর। পথে পড়ল রামকৃষ্ণপুর গ্রাম। এই গ্রাম দ্রুত পার হয়ে গেল সে। অবশ্য এবার বোধহয় ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। আসলে স্টেশন থেকে নেমে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে পার হয়েছে বেচারী। যদিও তখন শীতকাল, তা সত্ত্বেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
কয়েকটা গ্রাম পার হয়েছে, কিন্তু এখনও গোবিন্দপুর আসেনি। চলতি পথে যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তার কাছেই পথের হদিস জানতে চাইছে সে। তবু সংশয়, ভুল পথে চলছে না তো? খুব তাড়াতাড়ি তাকে গোবিন্দপুরে পৌঁছোতে হবে। সেখানে অনেক কাজ বাকি আছে। হঠাৎ এক চাষীকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, গোবিন্দপুর গ্রামটা কোনদিকে বলতে পারেন?”
চাষী তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আর একটু সামনে চলে যাও।”
কিছুদূর যাবার পর সেই যুবকটি দেখলো, কয়েকজন রাখাল বালক মাঠে খেলা করছে। সে তখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করল গোবিন্দপুর গ্রামটা কোন দিকে?
রাখাল বালকেরা বলল, “এই যে গ্রাম, ওটা পার হলে একটা বাঁশঝাড়। তারপর ডানদিকে গেলেই তুমি গোবিন্দপুর গ্রামে পৌঁছে যাবে।”
হাঁটতে হাঁটতে আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে সেই যুবক। এবার কেমন যেন ক্লান্তি এসে গ্রাস করে তাকে। বেচারী! অনেকক্ষণ হাঁটছে সে। কোথায় গোবিন্দপুর, কিছুই বুঝতে পারছে না।
গ্রামের একদিকে খোলা মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। তাদের জিজ্ঞাসা করল, ভাই, এটা কি গোবিন্দপুর?”
ছেলেরা খেলতে খেলতে অবাক চোখে লোকটির দিকে তাকায়। ভাবে, এ বোধ হয় এগাঁয়ে নতুন এসেছে। তাই গোবিন্দপুরের ঠিকানা চাইছে। তাদের একজন মাথা নেড়ে বলে – হ্যাঁ। এবার যুবক কিছুটা আস্বস্ত হয়। গ্রামের পথ ধরে আবার হাঁটতে শুরু করে। দু’পাশে মাটির ঘর। কোথাওবা খড় দিয়ে ছাউনি তৈরি করা হয়েছে। কোথাও আছে টিনের চাল। কোথাও বা টালি ।
দেওয়ালে অস্ফুট হাতে আঁকা নানা ছবি। মাঝে মধ্যে দু-একটা পাকা বাড়ি চোখে পড়ছে। ওই দেখা যাচ্ছে ধানের গোলা। খড়ের পালুই। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে খেলা করছে। দুষ্টু ছেলে মায়ের ডাকে সাড়াই দিচ্ছে না। হাঁসের দল প্যাকপ্যাক শব্দ করে সাঁতার কাটছে। ভারি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। এই দৃশ্য দেখার জন্যই তো বারবার গ্রামবাংলায় ফিরে আসতে হয়। এই ঘরোয়া দৃশ্যগুলি দেখে যুবকের মন কেমন যেন উদাসীন হয়ে যায়? কিন্তু গ্রামটা কোথায়? সত্যি কি এটা গোবিন্দপুর?
চলতে চলতে সে এক সময় থেমে যায়। দেখল এক বৃদ্ধ ঘরের সামনে খাটিয়াতে বসে আছেন। চোখ দুটি বন্ধ। তাঁকে দেখেই বোঝা যায়, এ জীবনে তাঁকে অনেক উত্থান পতনের সাক্ষী হতে হয়েছে। আর তাই বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছেন। আপন মনে তামাক খাচ্ছেন। পরিতৃপ্তির একটা ছাপ এই বৃদ্ধের সমস্ত চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
এবার যুবক জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদু, এটা কি গোবিন্দপুর গ্রাম?’
চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন বৃদ্ধ। মনে মনে অনেক কথাই ভাবছিলেন তিনি। ফেলে আসা অতীতের কথা। তাঁর ছোটোবেলা, যৌবন দিনের কথা, দেখতে দেখতে কত বছর বয়স হয়ে গেল। তিনি এবার চোখ খুলে তাকালেন ওই যুবকের দিকে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। প্রথমেই তিনি এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। কে এখন জ্বালাতে এসেছে? আমার এমন মিষ্টি মৌজ একেবারে মাটি করে দিল ।
ছেলেটি অধৈর্য হয়ে আবার প্রশ্ন করল – “আচ্ছাদাদু, আপনি কি আমার কথাটা শুনতে পাচ্ছেন না? গোবিন্দপুর গ্রাম আর কত দূর? আমি কি গোবিন্দপুরে পৌঁছে গিয়েছি?”
এবারও যুবকের কথায় কান দিলেন না ওই বৃদ্ধ। চোখ বন্ধ করে তামাকে গুরুক গুরুক টান মারতে লাগলেন। এই ব্যবহারে যুবক খুবই দুঃখ পেল। সে ভাবল, আহা, মানুষটি আমার সাথে কথা বললেন না কেন?
এবার বুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন—“তুমি গোবিন্দপুর গ্রাম কোথায়, তার হদিস জানতে চাইছিলে? এই গাঁ থেকে আরও মাইল খানেক হবে।”
বৃদ্ধের এই কথায় যুবক খুব অবাক হয়ে গেল। এতক্ষণ বারবার প্রশ্ন করেও সে তার প্রশ্নের জবাব পায়নি। বুদ্ধ চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। চরম অপমান করেছিলেন। আর এখন কিনা উঠে দাঁড়িয়ে পথের হদিস বলে দিচ্ছেন! এ কেমন ধারা মানুষ !
যুবক কিছুটা এগিয়ে এসে ভাবল, না পায়ে পায়ে বৃদ্ধের কাছে আবার যাই। ওই বৃদ্ধের কাছে গিয়ে তাঁর এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণ জানতে হবে বৈকি। সে তখন পায়ে পায়ে পিছিয়ে আবার বৃদ্ধের বাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধ একমনে তামাক খাচ্ছিলেন। যুবককে দেখে চোখ খুললেন। তাঁর চোখে-মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। তাঁকে দেখে মনে হয়, তিনি বুঝি জানতেন যে, যুবকটি ফিরে আসবে।
এবার যুবক বলল – “দাদু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, আশাকরি আপনি আমার কথায় রাগ করবেন না।”
একথা শুনেও বৃদ্ধ নির্লিপ্ত মুখে তামাকে টান দিতে লাগলেন। তাঁর এহেন আচরণে যুবকটি আবার অপমানিত বোধ করলো, কিন্তু তার মনে যে প্রশ্ন জেগেছে, তার জবাব যে পেতেই হবে। সে বলল – “দাদু, আমি তখন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে গোবিন্দপুর গ্রামের হদিস জানতে চাইলাম, অথচ আপনি চোখ বন্ধ করে তামাক টানতে লাগলেন। আপনাকে দেখে মনে হল আপনি বোধহয় আমার কথা শুনতেই পাননি, অথবা শুনতে পেয়েও অযথা আমাকে অপমান করছেন। আর আমি যখন একপা দুপা করে খানিকদূর এগিয়ে ‘গেলাম, তখন আপনি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওই গ্রামের হদিস বললেন। আপনার এহেন অদ্ভুত আচরণের কোনো কারণ আমি তো খুঁজে পাচ্ছি না। অনুগ্রহ করে বলবেন কি, আপনি কেন এমন আচরণ করলেন?”
যুবকটি ভেবেছিল, এমন বেয়ারা প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ হয়ত রাগ করবেন। কিন্তু এতক্ষণে বৃদ্ধ হেসে উঠলেন। তিনি বললেন – “ঠিকই বলেছো বাবা, দেখতে দেখতে আমার বয়স তো অনেক হল? অনেকের সাথে মেলামেশা করলাম। অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। যখন তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে, তখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল তুমি বোধহয় সত্যি সত্যি গোবিন্দপুর গ্রামে যেতে চাইছো না। তাই আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দিইনি। আর যখন দেখলাম, তুমি আমার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে নিজেই একপা একপা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছো, তখন বুঝতে পারলাম, তুমি সত্যি সত্যি গোবিন্দপুরে যেতে চাইছো। তাই তাড়াতাড়ি তোমাকে গাঁয়ের হদিস বলে দিলাম।”
যুবক বুঝতে পারল, ওই বৃদ্ধ কত চালাক। সত্যিই তো, পথে না নামলে আমরা পথের হদিস পাব কেমন করে?
মূলভাব: যে কোনো কাজে সফল হতে হলে দীর্ঘ পরিশ্রম, ত্যাগ ও তিতিক্ষা করা দরকার। কাজকে কঠিন ভেবে আমরা যদি নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি, তাহলে সাফল্য আসবে কি? জীবনে চলার পথে আমাদের প্রতিমুহূর্তে নানা প্রতিবন্ধকতার সামনে দাঁড়াতে হয়। সব কাজেই যে আমরা অনায়াসে সফল হব, তা কখনও ভাবা উচিত নয়। যে কোনো সফল মানুষের জীবনে অনেক উত্থান আর পতন থাকে। থাকে অনেক আঘাত প্রতিঘাত, যে প্রকৃত মানুষ সে আঘাতকে জয় করতে পারে, সেই মানুষ শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ এইভাবেই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ আমাদের দিয়ে গেছেন।